ধর্ষণ নৈরাজ্য ও বিচার: পুরুষতন্ত্র, গণমাধ্যম ও কাঠামো পরিবর্তনের লড়াই

মার্চ মাসে প্রায় শতাধিক ধর্ষণের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ধর্ষণ শুধু যৌন অপরাধ নয়, এটি এক ধরনের বিকৃত যৌন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। এটি একদিকে নারীর ওপর ক্ষমতার দখলদারিত্বের প্রতিফলন, অন্যদিকে সমাজের গভীরে প্রোথিত লিঙ্গবৈষম্যের প্রকট উদাহরণ। ধর্ষকের মানসিকতা জিঘাংসায় উন্মত্ত, অথচ সে সমাজের ছায়ায় অনায়াসে বিচরণ করে—যেন কিছুই হয়নি।
ধর্ষণের পর বিচারের ভাষা বা রেটরিক্সও পুরুষতন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ধর্ষক যদি ফাঁসির রায় পেলেও, কাঠামো কি বদলায়? উত্তর বারবার একই—'না'। রাষ্ট্র ও সমাজ এ প্রশ্নের সামনে বারবার নতজানু হয়। শাস্তির দাবি যৌক্তিক হলেও, এটিকে একমাত্র সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে সমস্যার গভীরতর কারণগুলো আড়ালে থেকে যায়।
ধর্ষণ শুধু ব্যক্তিগত বিপর্যয় নয়, এটি নারীর অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন কোনো নারী শ্রমজীবী, গৃহকর্মী, পোশাকশ্রমিক বা আদিবাসী হন, তখন ধর্ষণের পর ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা আরও কমে যায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাহীনতার কারণে ধর্ষকের জন্য তাকে দমন করা সহজ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে নারী শ্রমিকদের প্রতি সহিংসতা প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে, কারণ মূলধারার প্রচারমাধ্যম ও রাষ্ট্র তাদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দেয় না।
নারীকে কেবল মা, কন্যা বা স্ত্রী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার সংস্কৃতি বদলানো জরুরি। নারীর স্বতন্ত্র সত্তাকে স্বীকার না করলে, তার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। 'লজ্জা', 'ইজ্জত' ও 'পরিবারের সম্মান'—এ শব্দগুলোর মাধ্যমে ধর্ষণের পরও নারীকেই অপরাধী বানানো হয়, যা সমাজে ধর্ষণের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখে। ধর্ষণের জন্য দায়ী ধর্ষক, তার বিকৃত মানসিকতা এবং তাকে প্রশ্রয় দেওয়া সমাজ। নারীর পোশাক, চলাফেরা বা আচরণ কখনোই ধর্ষণের কারণ নয়; বরং ধর্ষণের মূল কারণ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সেই ক্ষমতার কাঠামো, যেখানে নারীকে অধীনস্থ রাখা হয়।
তাই ধর্ষণের বিচারের জন্য করা আন্দোলনগুলোকে শুধু ফাঁসির দাবিতে সীমাবদ্ধ না রেখে কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবিও তুলতে হবে। ন্যায়বিচারের অংশ কেবল শাস্তি দেওয়া নয়, বরং ধর্ষণের কারণগুলো নির্মূল করাও জরুরি। স্কুল-কলেজে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব শেখানো এবং পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। পুলিশি তদন্ত প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগী নারীরা যেন হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করা এবং কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী কঠোর নীতিমালা কার্যকর করা জরুরি। অভিযোগকারী নারী যেন নিরাপদ পরিবেশে বিচার পান, এ দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রের।
ধর্ষণ মূলত ক্ষমতার অপব্যবহার। এটি তখনই ঘটে যখন রাষ্ট্র, সমাজ ও বিচারব্যবস্থা নারীর প্রতি সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আইন ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য করলেও, বিচার পেতে নারীদের যে দীর্ঘ ও হতাশাজনক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা বিচারহীনতাকে উৎসাহিত করে। অনেকক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী বিচার চাইতে ভয় পান, কারণ তিনি জানেন—তার ওপর অত্যাচার হলেও, বিচারের কাঠগড়ায় তাকেই দোষারোপ করা হতে পারে।
ধর্ষণ নিছক সহিংসতা নয়; এটি শারীরিক এবং মানসিকভাবে একজন নারীকে ধ্বংস করার অস্ত্র। অনেকক্ষেত্রে এটি ব্যক্তিগত হীনমন্যতা, বিকৃত আকাঙ্ক্ষা বা ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। ধর্ষকরা অনেক সময় তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম থাকে এবং এটিকে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে দেখে। বাংলাদেশে ধর্ষণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক ভয়াবহ রোগ, যেখানে নারীর প্রতি অগ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন স্পষ্ট।
আজকাল গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রও ধর্ষণ সংস্কৃতির প্রসারে ভূমিকা রাখছে। অনেক সিনেমা ও সিরিজ ধর্ষককে 'নায়কোচিত' চরিত্রে উপস্থাপন করে, কখনো কখনো ধর্ষণকে 'ভালোবাসার' অংশ হিসেবে দেখায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় ও হলিউডের বহু চলচ্চিত্রে এ প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
অনেক সময়ই এসব আধেয়ে নায়কের জোরপূর্বক শারীরিক বা মানসিক প্রভাব খাটানোকে প্রায়ই 'পুরুষালি আকর্ষণ' হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
নায়িকা প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে প্রেমে পড়ে যায়, যা 'না মানে হ্যাঁ'-এর ভ্রান্ত ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এ ধরনের চিত্রায়ণ ধর্ষণের মতো অপরাধকে বৈধতা দেয়, বিশেষ করে প্রতিশোধের মাধ্যম হিসেবে (যেমন, প্রতিশোধমূলক ধর্ষণ)। এটি নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে বিকৃত যৌন রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে এবং ধর্ষকের মানসিকতাকে স্বাভাবিক করে তোলে।
গ্ল্যামার ও বিনোদনের নামে নারীদের কেবলমাত্র যৌনীকরণ ও 'বস্তুতে' পরিণত করা হয়। বিজ্ঞাপন ও মিউজিক ভিডিওতে নারীদের শরীরের নির্দিষ্ট অংশের ওপর অপ্রয়োজনীয় জোর দেওয়া হয়। আইটেম সং বা পপ কালচারের মাধ্যমে নারীদের 'উপভোগের বস্তু' হিসেবে দেখানো হয়।
অনেক কমেডি শো এবং চলচ্চিত্রে ধর্ষণকে কৌতুক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ভিডিও গেম ও মিম কালচারের মাধ্যমে এটিকে 'মজার বিষয়' হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এমনকি টক শো ও গণমাধ্যমর বিতর্কেও ধর্ষকের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর নজির আছে।
ধর্ষকদের অনেক সময় হিরো বা শক্তিশালী চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়, বিশেষ করে 'মাসকুলিন' ক্যারেক্টারদের ক্ষেত্রে। নারীর পোশাক, আচরণ বা স্বাধীনতাকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে দেখানো হয়। অথচ, আদতে ধর্ষণকে প্রতিশোধের সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে—এ বিষয়ে গণমাধ্যম কতটা সচেতন?
যৌন সহিংসতার বিকৃত উপস্থাপনা ও ফেটিশাইজেশন বর্তমানে গণমাধ্যমে ক্রমশ বেড়ে চলেছে। অনেক চলচ্চিত্র ও সিরিজে ধর্ষণের দৃশ্যকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ করা হয়, যাতে তা যৌন আকর্ষণের উপকরণ হয়ে ওঠে। এমনকি এসব দৃশ্যের সিনেমাটোগ্রাফি ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এমনভাবে সাজানো হয়, যা দর্শকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে—এটি কি বর্বরতা, না-কি কামনা? এর ফলে বাস্তব জীবনেও ধর্ষণকে 'নির্দোষ ফ্যান্টাসি' হিসেবে দেখা হতে পারে।
গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রের এ ভূমিকা শুধু বিকৃত মানসিকতাকে উসকে দেয় না, বরং এটি নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও দায়ী। এমন উপস্থাপনাগুলো বন্ধ হওয়া দরকার, কারণ সমাজের মানসিকতা গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে এবং ধর্ষণের মতো অপরাধকে 'গৌরবান্বিত বা স্বাভাবিক' করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
যৌন সহিংসতাকে স্বাভাবিক করার এ প্রবণতা রুখতে হলে আমাদের সাংস্কৃতিক উপস্থাপনাগুলো নিয়ে আরও সচেতন হতে হবে। আমাদের যৌনতা ও ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। ধর্ষণ কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা কল্পনা নয়, এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা, যার রাজনৈতিক মাত্রাও রয়েছে। গণমাধ্যমর দায়িত্ব এটিকে উপলব্ধি করা।
সামাজিক মাধ্যম এখন নারীদের আরও বেশি অবজেক্টিফাই করছে—তাদের শারীরিক সৌন্দর্যকে কেবল লাইক বা কমেন্টের মাধ্যমে বিচার করা হচ্ছে। এখানে একজন নারীর সম্পূর্ণতা বা মূল্য তার শারীরিক গঠনের ওপর নির্ভর করছে, তার ব্যক্তিত্ব বা চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। 'বিকৃত যৌনতা'র ধারণাগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে, যা নারীদের শুধু বস্তু হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। এ মানসিকতা সমর্থিত হলে নারীরা আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলে, এবং তা ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্ম দেয়।
'ভিকটিম ব্লেমিং' আমাদের সমাজে একটি বড় সমস্যা। ধর্ষণের শিকার নারীর পরিধান, আচরণ বা জীবনযাপনকে দায়ী করা হয়, অথচ ধর্ষণ একটি শাসনমূলক আচরণ, যেখানে অপরাধীই দায়ী। বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা অপরাধী ও সমাজের মধ্যে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা তৈরি করে। আইনগত বা সামাজিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা প্রায়শই অপর্যাপ্ত থেকে যায়, ফলে অপরাধীরা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়।
পুরুষতন্ত্রের প্রচলিত কাঠামো অটল থাকলে ধর্ষণ ঘটতেই থাকবে। লড়াই হওয়া উচিত এ কাঠামো ভাঙার বিরুদ্ধে—শুধু শাস্তির দাবি করে নয়, বরং সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, 'রেপ ইজ আ পার্ভার্স সেক্সুয়াল কালচার উইদ নো ক্লাস।'
লেখক: শিক্ষার্থী ও উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।