বলিউড বাঁচাতে কম খরচে নিজের সিনেমা দেখাবেন আমির; মুক্তি দেবেন ইউটিউবে
প্রায় এক দশক আগে একটি বিষয় খেয়াল করে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিলেন বলিউডের সফল তারকা আমির খান। দীর্ঘ তিন দশকের ক্যারিয়ারে তিনি দেখেছিলেন, ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ২-৩ শতাংশই সিনেমা হলে সিনেমা দেখেন।
ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও প্রান্তিক অঞ্চলে সিনেমা দেখার সুযোগ সীমিত হওয়ায় দর্শক সংখ্যা খুব কম। 'লাগান', 'থ্রি ইডিয়টস' ও 'তারে জমিন পর' সহ বহু প্রশংসিত ছবির অভিনয়, পরিচালনা ও প্রযোজনায় জড়িত আমির খান বহু বছর ধরে গ্রামীণ এলাকায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কম খরচে সিনেমা দেখার জন্য হাজার হাজার হল গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সরকারি জটিলতা ও প্রশাসনিক বাধার কারণে ওই পরিকল্পনা সফল হয়নি।
অন্যদিকে, সিনেমা হলে যাওয়া এখন অনেক পরিবারে বড় অর্থনৈতিক চাপের বিষয়। আগে সিনেমা হলে যাওয়া ছিল সামাজিক আনন্দের উৎস, যেখানে পরিবার-পরিজন মিলেও ছবি উপভোগ করতেন, টিকিটের দাম ছিল মাত্র কয়েক টাকা। কিন্তু এখন মাল্টিপ্লেক্সের আধিপত্যে সেই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এখন একেকটি টিকিটের দাম ৫০০ রুপি বা তার বেশি, যা দেশের বেশিরভাগ পরিবারের জন্যই অতিরিক্ত ব্যয়সাধ্য।
আমির খান বলেন, 'আমার প্রথম ছবি মুক্তির সময় টিকিটের দাম ছিল ১০ রুপি, তখন সবাই পরিবার নিয়ে হলে যেতে পারত।' ৬০ বছর বয়সী এই অভিনেতা যোগ করেন, 'সিনেমা হল এখন গণমাধ্যম নয়, উচ্চবিত্তদের জন্য এক বিশেষ মাধ্যম হয়ে গেছে। আর নির্মাতারা সেই ৯৭ শতাংশ দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।'
ফলে অনেকে এখন বিকল্পে স্যাটেলাইট টিভি বা মোবাইলে পাইরেটেড ছবি দেখতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে, এই সপ্তাহে আমির খান 'ভারতীয় সিনেমার ভবিষ্যৎ' নামে নতুন একটি উদ্যোগ ঘোষণা করেছেন। তার সাম্প্রতিক ছবি 'সিতারে জমিন পার' প্রথাগত সিনেমা হলে প্রদর্শনের পর ইউটিউবে মাত্র ১০০ রুপিতে মুক্তি পাবে। আগের এবং ভবিষ্যতের অন্যান্য ছবির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।
আমির খান বলেন, 'ইউটিউব ভারতের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ৪৯ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী আছেন, নেটফ্লিক্সের তুলনায় অনেক বেশি। এর এমন ব্যাপক বিস্তৃতি বিবেচনা করলে সিদ্ধান্তটা খুবই স্পষ্ট ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এতটাই বেড়েছে যে সিনেমা হলের প্রয়োজন কমে এসেছে। আমি মনে করি, এই মডেলই সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে এবং একইসঙ্গে চলচ্চিত্রশিল্পের সৃষ্টিশীল সম্প্রদায়েরও উপকারে আসবে। অবশ্যই সিনেমার প্রথম গন্তব্য হওয়া উচিত সিনেমা হল। কিন্তু এরপর সেগুলো এমনভাবে উন্মুক্ত হওয়া উচিত, যাতে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী স্বল্পমূল্যে দেখতে পারে।'
আমির খান বলেন, তিনি সবসময় চান দর্শক বড় পর্দায় ছবি দেখুক। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য সিনেমা হল সহজলভ্য নয়।
অন্যদিকে, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো ভারতীয় সিনেমার জন্য সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করেন তিনি। ছবি হলে মুক্তির পর দর্শকের নজর কাড়ার আগেই অসংখ্য কনটেন্টের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে—যাকে তিনি বলছেন ভারতীয় সিনেমার 'ক্যানিবালাইজেশন'।
খান বলেন, 'এই মুহূর্তে আমি মনে করি সিনেমা একটি কঠিন সময় পার করছে, আর আমি চেষ্টা করছি তাতে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে আনতে।'
তবে সংকট শুধু বক্স অফিসে ধস নয়। গত এক দশকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব বাড়ায় সেন্সর বোর্ডের কঠোরতা বেড়েছে। রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয় নিষিদ্ধ বা পরিবর্তনের ফলে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে।
বলিউডের খ্যাতনামা 'তিন খান'—আমির খান, শাহরুখ খান ও সালমান খান—সবই মুসলিম হওয়ায় হিন্দুত্ববাদী মহলের টার্গেটে রয়েছেন। এসব মহল তাদের ছবি বয়কটের ডাক দিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণাভিত্তিক প্রচার চালিয়েছে, এমনকি তাদের 'ভারতবিরোধী' বলেও অভিযুক্ত করেছে।
দশ বছর আগে আমির খানের 'বর্ধমান অসহিষ্ণুতা'র মধ্যে নিজেকে অনিরাপদ মনে করার মন্তব্যের পর তিনি দেশজুড়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। খান স্বীকার করেন, অনেক নির্মাতা এখন তাদের সৃজনশীল স্বাধীনতা হারানোর অনুভূতি পাচ্ছেন, কারণ প্রভাবশালী মহল তাদের ভাষা নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি বলেন, 'অনেকেই মনে করেন তারা নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়েছেন।'
তবে খান মনে করেন সেন্সরশিপ নতুন কিছু নয়, ১৯৪০-এর দশক থেকেই এ ধরনের চাপ চালু আছে। তার কথায়, 'প্রত্যেক সমাজেই একটি অংশ থাকে যারা সবকিছু নেতিবাচকভাবে দেখে, আর এরা কখনোই পুরোপুরি হারিয়ে যাবে না।'
অবসরের চিন্তা তিনি করেছেন, এমনকি মহামারির সময় একপর্যায়ে 'চুপিচুপি ছয় মাসের জন্য অবসরেও' ছিলেন বলে জানান খান। তবুও ভারতীয় সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আশাবাদী।
তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি এই নতুন মডেল সফল হবে, আর যদি না হয়—আমরা সবাই বিপদে পড়ব।'
