আবারও এক হচ্ছে বিটিএস, কিন্তু কে-পপ জগৎ কি আগের মতো আছে?
দুই বছরেরও বেশি সময় পর, অবশেষে আবার এক হতে যাচ্ছে বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড বিটিএস। প্রতীক্ষার এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের 'আর্মি' সদস্যরা যেমন আবেগাপ্লুত, তেমনি দক্ষিণ কোরিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ায় শুরু হয়েছে উৎসবের আমেজ।
সিউলের উপকণ্ঠে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো বার্ষিক 'বিটিএস ফেস্টা'। ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠান এবার ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে—কারণ পুনর্মিলনের সময় এখন আর খুব দূরে নয়।
সেখানেই দেখা গেল সুদূর ব্রাজিল থেকে আসা একনিষ্ঠ ভক্ত স্টেফানি প্রাডোকে। বিটিএসের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি চলে এসেছেন দক্ষিণ কোরিয়ায়।
স্টেফানি জানান, গত আড়াই বছর ধরে ব্যান্ডটির পূর্ণ পুনর্মিলনের জন্য তিনি অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। অপেক্ষার দিনগুলো কেটেছে 'একদিকে বেশ ধীরে, আবার অন্যদিকে খুবই দ্রুত'—বলেই স্টেফানি অন্যান্য ভক্তদের সাথে হাতে নাড়াতে থাকেন বিটিএস ভক্তদের নিজস্ব 'আর্মি বম্ব' লাইটস্টিকটি।
বর্তমানে ব্যান্ডের সাত সদস্যের মধ্যে চারজন—আরএম, ভি, জিমিন ও জাংকুক—ইতোমধ্যে তাদের বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা শেষ করেছেন। আজ শনিবার ব্যান্ডের সদস্য সুগা দায়িত্ব শেষ করলেই আনুষ্ঠানিকভাবে আবার এক হতে যাচ্ছে বিটিএস।
স্টেফানি বলেন, 'আমি চাই ওরা বিশ্রাম নিক, তবে হ্যাঁ—অ্যালবাম, কনসার্ট এসবও তো চাই!'
বিটিএস এবং কে-পপের 'সামরিক-বিরতির অভিশাপ'
কে-পপ জগতে বহুদিন ধরেই একটি কথা চালু আছে—'সামরিক-বিরতির অভিশাপ'। দক্ষিণ কোরিয়ায় পুরুষদের জন্য ১৮ মাসের বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা অনেক শিল্পীর ক্যারিয়ারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই বাধার মুখেই ২০২২ সালে কার্যক্রম স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড বিটিএস।
কিন্তু এবার তারা ফিরছে—এক ভিন্ন বাস্তবতায়। গত দুই বছরে কেপপের চেনা দৃশ্যপট অনেকটাই পাল্টে গেছে। অ্যালবাম বিক্রি কমেছে, একের পর এক কেলেঙ্কারিতে নড়েচড়ে উঠেছে ইন্ডাস্ট্রি, এবং শিল্পীদের উপর অমানবিক মানসিক চাপ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
শিল্প বিশ্লেষকদের মতে, বিটিএসের অনুপস্থিতি কোরিয়ান পপ জগতে একটি বড় শূন্যতা তৈরি করেছিল।
'বিটিএস: দ্য রিভিউ' বইয়ের লেখক ও সংগীত সমালোচক কিম ইয়ং-ডে বলেন, 'বিটিএস ছাড়া যেন কেপপ-এর এক মূল স্তম্ভ অনুপস্থিত ছিল।' তিনি যোগ করেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে বলছিলেন, কেপপ তার গতি হারাচ্ছে। সেটা সত্য হোক বা না হোক—বিটিএসের প্রত্যাবর্তন সে ধারণা বদলে দিতে পারে।'
বিশ্লেষকদের ধারণা, এই দীর্ঘ বিরতির সময়সীমা বিটিএস কৌশলে ভাগ করে নিয়েছে যাতে একসঙ্গে পুরো ব্যান্ড ছয় মাসের বেশি অনুপস্থিত না থাকে। গত অক্টোবরে সামরিক দায়িত্ব শেষ করা জে-হোপ এরপর সলো বিশ্ব সফরও সম্পন্ন করেছেন।
তবু এই 'সামরিক-বিরতির অভিশাপ' সহজে কাটে না।
প্রথমত, প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন ব্যান্ড আত্মপ্রকাশ করায় ভক্তদের মনযোগ ও আনুগত্য দ্রুত বদলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সামরিক অভিজ্ঞতা কে-পপের প্রাণবন্ত যৌবনশক্তিকে কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে।
তবে কিম ইয়ং-ডে আশাবাদী, 'যদি কেউ এই অভিশাপ ভাঙতে পারে, সেটা বিটিএস।' তিনি বলেন, 'সদস্যরা সামরিক দায়িত্বের মধ্যেও একক প্রকল্পে সক্রিয় থেকেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ভক্তদের আগ্রহে কোনো ভাটা পড়েনি। এটাই প্রমাণ করে যে বিটিএসের অনুপস্থিতিও যেন তাদের উপস্থিতির মতোই প্রভাবশালী ছিল।'
নতুন প্রজন্ম বনাম পুরনো কিংবদন্তি
বিটিএস নিয়ে ভক্তদের মধ্যে উত্তেজনার কমতি নেই। ফেস্টা উদ্বোধনের ঘণ্টাখানেক আগেই সাবওয়ে স্টেশন পর্যন্ত লাইন পড়ে যায়। কেউ কেউ 'ভয়েস জোন' নামের বুথে ঢুকে বিটিএস সদস্যদের কণ্ঠ শুনে আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়ছিলেন।
তবে আর্মিদের আবেগ যত গভীরই হোক, কেপপের জগৎ বিটিএস এর অনুপস্থিতিতে অনেকটাই পাল্টে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার পপ ইন্ডাস্ট্রির বিটিএস এবং ব্ল্যাকপিঙ্ক-এর মতো জনপ্রিয় তৃতীয় প্রজন্মের তারকারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন অ্যালবাম আনেনি। বেশিরভাগই মনোযোগ দিয়েছেন একক প্রকল্পে।
কিন্তু এখন পপ ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্রে থাকা চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের শিল্পীদের বিটিএসের মতো একক কোনো 'ফেস অব কেপপ' উপাধি না থাকলেও, বৈচিত্র্য আর পরীক্ষামূলক ধারা এই প্রজন্মকে আলাদা করেছে।
১৩ বছর বয়সী একজন কোরিয়ান ভক্ত বলেন, 'আমার বয়সী অনেকেই এখন চতুর্থ প্রজন্মের আইডলদের ( কোরিয়ান পপ তারকা) পছন্দ করে। বিটিএসকে একটু পুরনো প্রজন্মের মনে হয়।"
কিন্তু প্রজন্মগত পরিবর্তনের বাইরেও বড় প্রশ্ন এখন কেপপ শিল্পের সামগ্রিক গতি ও আর্থিক চিত্র।
কনসার্ট থেকে আয় এখনও শক্তিশালী থাকলেও, অ্যালবাম বিক্রি—যা কেপপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সূচক—২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। এই সময়সীমাই মিলে যাচ্ছে বিটিএস ও ব্ল্যাকপিঙ্কের 'অ্যালবামবিহীন' সময়ের সঙ্গে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পপ সংস্কৃতি বিশ্লেষক পার্ক হি-আ বলেন, "বিটিএস যখন অনুপস্থিত ছিল, তখন কেপপ কিছুটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে।"
তার মতে, কেবল বাজার নয়, এই সময়টিতে একাধিক বিতর্ক কেপপ ইন্ডাস্ট্রির কাঠামোকেও নাড়িয়ে দিয়েছে।
যেমন জনপ্রিয় 'গার্ল গ্রুপ' নিউজিন্স ও তাদের এজেন্সির মধ্যে চাঞ্চল্যকর বিরোধ, শিল্পীদের প্রতি বড় বড় কোম্পানির আচরণ নিয়ে অভিযোগ, এমনকি ভক্ত ও ট্রোলদের হাতে তারকাদের হয়রানির মতো ঘটনাও সামনে এসেছে।
এই টালমাটাল বাস্তবতার মধ্যেই বিটিএসের প্রত্যাবর্তন যেন কেবল এক ব্যান্ডের ফেরা নয়, বরং গোটা কেপপ জগতের জন্য এক আশাবাদের মুহূর্ত।
সাংস্কৃতিক বিশ্লেষক পার্ক হি-আ বলেন, 'তাদের ফেরাটা মানুষকে আবার কোরিয়ান সংগীতের দিকে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। এটি কেবল আর্মিদের জন্যই নয়—বরং কোরিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব এর জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
তাই এখন চোখ সবার বিটিএসের পরবর্তী অ্যালবামের দিকেই।
নিজের সামরিক দায়িত্ব শেষের দিন ব্যান্ডের প্রধান আরএম বলেছিলেন, 'আমি দ্রুতই অ্যালবাম তৈরি করব এবং মঞ্চে ফিরব।'
তবে পূর্ণ ব্যান্ডের নতুন অ্যালবাম হয়তো খুব শিগগির আসছে না। কারণ ব্যান্ডের সদস্য জে-হোপের এখনও ঘরোয়া কনসার্ট রয়েছে, আর অন্য সদস্য জিন বিশ্বজুড়ে ফ্যানদের জন্য একাধিক আয়োজন করতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, সুগা—যিনি গত বছর মদ্যপ অবস্থায় স্কুটার চালানোর অভিযোগে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন—সম্ভবত কিছুদিন আড়ালে থাকতে চাইবেন।
তবুও স্টেফানি প্রাডোর মতো লাখো ভক্তের কাছে এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় খবর—সাতজন আবার এক হয়েছেন। লাখো লাখো মানুষ এই পুনর্মিলনের সাক্ষী হতে দক্ষিণ কোরিয়ায় ভিড় জমিয়েছেন। তাদের কাছে, এই মুহূর্তটিই যথেষ্ট।
