‘বাইসাইকেল থিভস’ চলচ্চিত্রের সেই শিশু অভিনেতা এনজো স্তাইওলা মারা গেছেন

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতালিয়ান নিওরিয়ালিস্ট চলচ্চিত্র 'বাইসাইকেল থিভস'(১৯৪৮)-এর ক্ষুদে অভিনেতা এনজো স্তাইওলা গত ৪ জুন রোমের একটি হাসপাতালে ৮৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। মাত্র আট বছর বয়সে তার অভিনয় করা চরিত্রটি আজও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে জীবন্ত।
চলচ্চিত্রের পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকা পথ চলতে গিয়ে স্তাইওলার নিষ্পাপ চোখ এবং নির্ভেজাল মুখাবয়ব দেখে তাকে সিনেমার জন্য নির্বাচিত করেন। তবে ৭ বছর পরেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিনেমা থেকে বিদায় নেন স্তাইওলা। এরপরও তার অভিনীত 'বাইসাইকেল থিভস' ছবির সে ক্যামেরার ক্লোজ-আপ দৃশ্য এখনো অমর হয়ে আছে।
ইতালীয় সাংবাদিক এবং স্তাইওলার পরিবারের বন্ধু ইমানুয়েল কারিওতি তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করে জানান, তিনি [স্তাইওলার] হঠাৎ পড়ে গিয়ে ব্যথা পান এবং সেখান থেকে তার শরীরের অবনতি ঘটতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তিনি মারা যান।
'নিওরিয়ালিস্ট' যুগের শেষ দিকের অন্যতম জীবিত সাক্ষ্য স্তাইওলার ছিলেন রোমের একজন সাধারণ ফল বিক্রেতার ছেলে। সে ফল বিক্রেতার ছেলেই একদিন ইতালীর ডাকটিকিটেও স্থান পান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, যখন অনেক ইতালীয় দারিদ্র্য আর ধ্বংসস্তূপে নিমজ্জিত ছিল, তখন ডি সিকা, রবার্তো রসেলিনি এবং লুকিনো ভিসকন্তির মতো পরিচালকরা অতীতের ফ্যান্টাসিমূলক চলচ্চিত্র ছেড়ে সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের কষ্ট আর বেদনার চিত্র তুলে ধরেন।
সেই সময় পরিচালকরা অভিনয়ের জন্য প্রায়শই অভিনেতা নন এমন মানুষদের বেছে নিতেন। আর তাদের মধ্যে এনজো স্তাইওলার উত্থান ছিল সবচেয়ে ব্যতিক্রমী—যিনি বাস্তব জীবনে অভিনেতা না হয়েও সিনেমার পর্দায় চিরস্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন।
'বাইসাইকেল থিভস'—ইতালীয় ভাষায় যার নাম 'লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে'—ছবিটি ১৯৪৯ সালে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একটি বিশেষ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
চলচ্চিত্রটি লেখক লুইজি বার্তোলিনির লেখা একটি উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেন চেজারে জাভাত্তিনি। ছবির কাহিনি এক তরুণ পিতার জীবনসংগ্রাম ঘিরে, যিনি তার পরিবারকে চালানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন।
বাইসাইকেল থিভস চলচ্চিত্রে বাবার চরিত্রে পরিচালক ভিটোরিও ডি সিকা বাস্তব জীবনের একজন কারখানাকর্মী, লামবার্তো মাদজিওরানিকে নির্বাচন করেন। সিনেমায় তিনি রোম শহরের দেয়ালে আমেরিকান চলচ্চিত্র তারকা রিটা হেওয়ার্থের মতো আবেদনময়ী নায়িকাদের পোস্টার সাঁটানোর কাজ পান।
চরিত্রটির নাম আন্তোনিও। সাইকেল ছাড়া নিজের কোনো কাজ করতে পারেন না আন্তোনিও। স্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় বিছানার চাদরগুলো বন্ধক দিয়ে একটি বন্ধক দোকান থেকে সাইকেলটি পুনরুদ্ধার করেন তিনি। কিন্তু সেই সাইকেলটি চুরি হয়ে গেলে, আন্তোনিও ও তার ছেলে ব্রুনো (যার ভূমিকায় ছিলেন এনজো স্তাইওলা) সারা শহরজুড়ে মরিয়া হয়ে সাইকেলটি খুঁজতে থাকেন। এই যাত্রা একদিকে কিছু ক্ষুদ্র আনন্দের মুহূর্ত উপহার দিলেও, শেষ পর্যন্ত তা রূপ নেয় চরম অপমানের এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতায়।
অনেকের বিবরণ অনুযায়ী, পরিচালক ভিটোরিও ডি সিকা একদিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এনজো স্তাইওলার নির্মল চোখ ও নিষ্পাপ মুখ দেখে মুগ্ধ হন (যদিও ছবিটির সংলাপ পরে পেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে ডাব করানো হয়েছিল)।
২০২৩ সালে, লা রিপাব্লিকা নামক এক ইতালীয় সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্তাইওলা বলেন, তিনি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় লক্ষ্য করেন একটি গাড়ি তাকে অনুসরণ করছে। পরে, একজন পরিপাটি পোশাক পরা ভদ্রলোক — যিনি ছিলেন ডি সিকা—গাড়ি থেকে নেমে তার নাম জানতে চান। কিন্তু, স্তাইওলার মা তাকে অচেনা কারও সঙ্গে কথা না বলতে বলেছিলেন, তাই তিনি কিছু বলেননি।
স্তাইওলা বলেন, ডি সিকা তখন তাকে অনুসরণ করে তাদের বাসায় চলে আসেন। তার মা–বাবা সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রকারকে চিনে ফেললে শুরুতে ছেলেকে সিনেমায় অভিনয় করতে দিতে রাজি হননি।
পরে স্তাইওলা জানান, তার এক চাচা তাকে আবার ডি সিকার কাছে অডিশনের জন্য নিয়ে যান। ডি সিকা তখনও ব্রুনো চরিত্রে স্তাইওলাকেই নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাই তিনি [ডি সিকা] আবারও তার মা–বাবার কাছে ফিরে যান এবং দুই মাসের কাজের জন্য ৩ লাখ লিরা পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দেন—যা সে সময়ে ছিল বিশাল অর্থ।
স্তাইওলার ভাষ্যমতে, এই পর্যায়ে তার বাবা হেসে বলেছিলেন, 'তুমি যদি আগামীকাল কাজে না যাও, তাহলে আমি তোমাকে মেরে ফেলব।'
তবে আরও কিছু সূত্র বলছে, ডি সিকা অন্তত দুইজন শিশুশিল্পী নিয়ে ছবির কিছু অংশ আগেই চিত্রায়ন করেছিলেন, তারপরই শেষ পর্যন্ত এনজো স্তাইওলাকে বেছে নেন।
বাইসাইকেল থিভস ছবির সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত—যেখানে এনজো স্তাইওলার চরিত্রটি দারিদ্র্যের কারণে তার পিতার পরিণতিতে কেঁদে ফেলে—এই দৃশ্য ধারণ নিয়ে কিছু রহস্য ও বিতর্ক রয়েছে বলে জানান চলচ্চিত্র গবেষক ক্যাথরিন ও'রাও।
তার মতে, পরিচালক ডি সিকা দাবি করেছিলেন, তিনি স্তাইওলাকে কাঁদাতে গিয়ে তাকে চিমটি কেটেছিলেন ও চড় মেরেছিলেন। যখন সেটিও কাজ করেনি, তখন তিনি চুপিচুপি ছেলেটির পকেটে কিছু সিগারেটের ফিল্টার ঢুকিয়ে দেন, তারপর পাবলিকের সামনে তাকে চুরির অভিযোগে অপমান করেন—এতে ছেলেটি কাঁদতে বাধ্য হয়।
তবে, স্তাইওলা অধিকাংশ সময় এই ঘটনা অস্বীকার করেছেন। কখনও তিনি বলেছেন, ডি সিকা তার চোখে গ্লিসারিন দিয়েছিলেন, আবার কখনও বলেছেন, পরিচালক তার চোখে ধোঁয়া দিয়েছিলেন তাকে কাঁদানোর জন্য।
যেভাবেই হোক, এই দৃশ্য ছিল চিরস্মরণীয় ও গভীর আবেগে ভরা, যা দর্শকদের মনে গেঁথে যায়।
১৯৪৯ সালে, নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর চলচ্চিত্র সমালোচক বসলি ক্রাউদার লিখেছিলেন, 'এনজো স্তাইওলা শিশু ছেলের চরিত্রে এমন দৃঢ়তা নিয়ে অভিনয় করেছে, যা ছেলেটির অন্তর্নিহিত সংবেদনশীলতা ও অটল সংকল্প উভয়কেই প্রকাশ করে।' তিনি শেষে মন্তব্য করেছিলেন, 'এই ছবি সবাইকে দেখতে হবে, এবং মনে দাগ পড়া উচিত।'
বাইসাইকেল থিভস-এর পর, স্তাইওলা প্রায় ডজনখানেক ছবিতে অভিনয় করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— আনা ম্যাগনানির সঙ্গে ভলকানো (১৯৫০), জিনা লোলোব্রিজিডার সঙ্গে দ্য হোয়াইট লাইন (১৯৫০), মারচেলো মাস্ত্রোইয়ান্নির সঙ্গে পেননে নেরে (১৯৫২), জোসেফ এল. ম্যানকিয়েভিজের পরিচালিত দ্য বেয়ারফুট কন্টেসা (১৯৫৪)। তবে, এই ছবিগুলোর কোনোটিই 'বাইসাইকেল থিভস'-এর মতো খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি।
স্তাইওলা পরবর্তীতে বলেন, তিনি সিনেমা থেকে সরে আসায় খুব বেশি আফসোস করতেন না। তাঁর ভাষায়, তখনকার বয়স অনুযায়ী সিনেমার কাজ ছিল কষ্টকর—কারণ তাঁকে স্বাধীনভাবে খেলতে দেওয়া হতো না, যদি মুখে আঘাত পান বা কেটে যায়, সে আশঙ্কায়।
চলচ্চিত্র গবেষক ক্যাথরিন ও'রাওর মতে, তবুও, বাইসাইকেল থিভস–এ অভিনয় দিয়েই স্তাইওলা ইতালীয় সিনেমায় অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তিনি বলেন, এই অভিনয় 'একেবারে অনন্য', এবং এই কারণেই মানুষ আজও বারবার সেই সিনেমায় ফিরে যায়।
এনজো স্তাইওলা ১৯৩৯ সালের ১৫ নভেম্বর রোমে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জানান, তিনি তার মা–বাবা ও চার ভাইবোনের সঙ্গে একটি দুই-কামরার ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। স্তাইওলা বলেন, তার মা কলসিয়ামের কাছে একটি দোকানে ফল বিক্রি করতেন, আর বাবা সিনেসিত্তা চলচ্চিত্র স্টুডিওর জন্য অতিরিক্ত অভিনয়শিল্পী জোগাড় করতে সহায়তা করতেন।
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় তখন স্তাইওলার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। তবে সাংবাদিক ইমানুয়েল কারিওতি জানান, যুদ্ধকালীন সময়ে স্তাইওলার সবচেয়ে তীব্র স্মৃতি ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, যেটি ডি সিকা ও অন্যান্য নিওরিয়ালিস্ট পরিচালকের সিনেমায়ও উঠে এসেছে।
বাইসাইকেল থিভস মুক্তির পর, স্তাইওলা জানান, তাঁর পরিবারকে রোমের গারবাতেলা এলাকায় সরকারি আবাসনে একটি বাড়ি দেওয়া হয়, যেখানে তিনি বাকি জীবন কাটিয়েছেন।
পরিণত বয়সে তিনি মাত্র দুটি ছবিতে অভিনয় করেন। তাদের একটি হলো—রেনেসাঁ যুগের পটভূমিতে নির্মিত 'স্প্যাডে সেনজা ব্যান্ডিয়েরা' (১৯৬১) এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য ঘিরে নির্মিত 'দ্য পাইজামা গার্ল কেস' (১৯৭৮)-এ।
অন্যান্য সময় তিনি সরকারি কাজ করে গেছেন। তিনি সম্পত্তি রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণ করার অফিসে কর্মরত ছিলেন।
এনজো স্তাইওলার স্ত্রী আনা তাঁর আগেই মারা যান। তাঁদের একটি ছেলে আছেন, নাম অ্যান্ড্রিয়া। তার সঙ্গেই থাকতেন স্তাইওলা।
জীবনের শেষ পর্যন্ত, যারা তাকে শৈশবে চিনতেন বা শুধু তার সিনেমার মাধ্যমে তাকে চিনেছেন, তাঁরা সহজেই তাকে চিনতে পারতেন। কখনো কখনো তারা তাঁর কাছে এসে বাইসাইকেল থিভস ছবির ক্লোজ-আপে দেখা সেই চোখগুলো দেখতে চাইতেন। স্তাইওলা মাঝে মাঝে সাক্ষাৎকারে ক্লান্ত বোধ করতেন এবং ক্যাথরিন ও'রাওর তার বইয়ে বলেছিলেন, তাঁর জন্য 'নিওরিয়ালিজম কখনো শেষ হয়নি'।
২০২৩ সালে লা রিপাব্লিকা পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, 'আপনি কি নিজেকে একজন কিংবদন্তি মনে করেন?' তিনি উত্তর দেন, 'অবশ্যই না। আপনার কাছে কি আমাকে দেখতে কিংবদন্তির মতো লাগছে? বলা যায়, আমার খুব সাধারণ জীবনে সেটি একটি অসাধারণ সময় ছিল।'