সড়ক দুর্ঘটনায় ১১৪ বছর বয়সে প্রাণ গেল বিশ্বের ‘সবচেয়ে প্রবীণ’ ম্যারাথন দৌড়বিদের

ফৌজা সিং বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবে পরিচিত ভারতের পাঞ্জাবে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ১১৪ বছর। খবর বিবিসির।
পুলিশ জানিয়েছে, পাঞ্জাবের নিজ গ্রামের রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি অজ্ঞাত গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তিনি মারা যান।
বিশ্বজুড়ে অনুপ্রেরণার প্রতীক ফৌজা সিং ৮৯ বছর বয়সে দৌড় শুরু করেন এবং ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৯টি পূর্ণাঙ্গ ম্যারাথন শেষ করেন। তখন তার বয়স ১০০ বছরের বেশি ছিল। ২০১৩ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন।
তার দৌড় ক্লাব ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান শিখস ইন দ্য সিটি জানিয়েছে, লন্ডনের ইলফোর্ডে তাদের আসন্ন আয়োজনগুলো ফৌজা সিংয়ের জীবন ও কৃতিত্বের উৎসবে পরিণত হবে। তিনি ১৯৯২ সাল থেকে সেখানে বসবাস করতেন।
গত সোমবার শতায়ু ফৌজা সিং তার জন্মগ্রাম বেয়াস পিণ্ডে হাঁটছিলেন তখন এ দুর্ঘটনা ঘটে। এই গ্রামটি পাঞ্জাবের জলন্ধরের কাছে অবস্থিত।
জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা হরবিন্দর সিং বলেছেন, 'তদন্ত চলছে এবং অভিযুক্তকে শিগগিরই আটক করা হবে।'
তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সর্বত্র থেকে শোকবার্তা আসতে শুরু করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে 'অসাধারণ ক্রীড়াবিদ এবং অতুলনীয় দৃঢ়সংকল্পের অধিকারী' বলে উল্লেখ করেছেন।
সিখস ইন দ্য সিটি দৌড় ক্লাবের কোচ হরমন্দর সিং এক বিবৃতিতে ফৌজা সিংয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে: 'অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমাদের মানবতার প্রতীক এবং ইতিবাচকতার শক্তি ফৌজা সিং ভারতের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
'তার দৌড় ক্লাব ও দাতব্য সংস্থা সিখস ইন দ্য সিটি আগামী ২৯ মার্চ ২০২৬ রবিবারের ফৌজা সিং বার্থডে চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত সকল আয়োজন তার সাফল্যময় জীবনের উদযাপনে উৎসর্গ করবে।
'আমরা তহবিল সংগ্রহের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করবো, যাতে ইলফোর্ডের সেই রুটে ফৌজা সিং ক্লাবহাউস নির্মাণ করা যায়, যেখানে তিনি অনুশীলন করতেন।'
বিবিসি যখন জুন মাসে বেয়াস পিণ্ডে ফৌজা সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখনও তিনি সুস্থ-সচল ছিলেন এবং প্রতিদিন কয়েক মাইল হাঁটতেন।

তিনি বলেছিলেন, 'আমি এখনো গ্রামের চারপাশে হাঁটি, যাতে পায়ের শক্তি বজায় থাকে। একজন মানুষকে নিজের শরীরের যত্ন নিজেকেই নিতে হয়।'
ফৌজা সিং ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের মশাল বাহক ছিলেন এবং তার দৌড়জীবনে বহু মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো — ২০১১ সালে টরন্টোতে তিনি বিশ্বের প্রথম শতবর্ষী হিসেবে পূর্ণাঙ্গ ম্যারাথন শেষ করেন।
তবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবে তার দাবিটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, কারণ তিনি ১৯১১ সালের জন্ম সনদপত্র দেখাতে পারেননি। তখন বিবিসি জানিয়েছিল, তার ব্রিটিশ পাসপোর্টে জন্মতারিখ ১ এপ্রিল ১৯১১ লেখা ছিল এবং ১০০তম জন্মদিনে রানির কাছ থেকে অভিনন্দনপত্রও পেয়েছিলেন তিনি।
তার প্রশিক্ষক হরমন্দর সিং বলেন, ফৌজা সিংয়ের জন্মের সময় ভারতে জন্ম সনদপত্র তৈরি করা হতো না।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা খুবই ইচ্ছুক ছিলেন তাকে এই রেকর্ড দিতে, তবে নিয়ম অনুযায়ী তারা শুধুমাত্র সেই বছরের তৈরি অফিসিয়াল জন্ম সনদপত্র গ্রহণ করতে বাধ্য।
পাঞ্জাবে বেড়ে ওঠা ছোটবেলায় ফৌজা সিংকে গ্রামের মানুষরা প্রায়ই উপহাস করত, কারণ তার পা দুর্বল ছিল এবং পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সে সঠিকভাবে হাঁটতেও পারত না।
কিন্তু বিবিসি পাঞ্জাবকে জুন মাসে তিনি বলেছিলেন, 'একই ছেলে, যাকে দুর্বলতার জন্য একসময় উপহাস করা হতো, সেইই ইতিহাস তৈরি করেছে।'
৪০ বছর বয়স হওয়ার আগেই পেশায় কৃষক ফৌজা সিং দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন ও দেশভাগের বেদনাও ভোগ করেছেন।
বিবিসি পাঞ্জাবকে তিনি বলেছিলেন, 'যৌবনে আমি "ম্যারাথন" শব্দটিই জানতাম না। আমি কোনোদিন স্কুলে যাইনি, কোনো খেলাধুলায়ও যুক্ত ছিলাম না। আমি ছিলাম কৃষক — জীবনের বড় একটি অংশ মাঠে কাটিয়েছি।'
তিনি প্রথম দৌড়াতে শুরু করেন শোক সামলানোর জন্য।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে তার স্ত্রী জিয়ান কৌর মারা যাওয়ার পর ফৌজা সিং লন্ডনে চলে আসেন বড় ছেলে সুখজিন্দার-এর সাথে থাকতে।
কিন্তু পরে ভারতে যাওয়ার সময় তিনি নিজের ছোট ছেলে কুলদীপকে একটি দুর্ঘটনায় মারা যেতে দেখেন। এই ঘটনার পর তিনি ভেঙে পড়েছিলেন।
শোকাচ্ছন্ন সিং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার ছেলের চিতা স্থলের কাছে বসে থাকতেন। বিষয়টি দেখে গ্রামের লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে এবং তার পরিবারকে পরামর্শ দেয় তাকে আবার যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে নিতে।
লন্ডনের ইলফোর্ডে ফিরে গিয়ে একদিন গুরদুয়ারায় যাওয়ার সময় সিং একদল বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে দেখা পান, যারা একসাথে দৌড়াতে যেতেন। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় হরমন্দর সিংয়ের, যিনি পরবর্তীতে তার কোচ হন।
তিনি জুন মাসে বলেছিলেন, 'যদি হরমন্দর সিংয়ের সঙ্গে দেখা না হতো, তাহলে আমি কখনো ম্যারাথন দৌড়ে নামতাম না।'
ফৌজা সিং ২০০০ সালে লন্ডন ম্যারাথন দিয়ে তার দৌড়জীবনের সূচনা করেন — তখন তার ৮৯ বছর পূর্ণ হতে মাত্র এক মাস বাকি ছিল।
তিনি গোল্ডেন বন্ড এন্ট্রি-এর মাধ্যমে অংশ নিয়েছিলেন — এই ব্যবস্থায় বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক অংশগ্রহণের সুযোগ কিনে রাখে। তিনি বিএলআইএসএস নামে একটি দাতব্য সংস্থার জন্য দৌড়েছিলেন, যা অকালজাত শিশুদের সহায়তা করে। তার স্লোগান ছিল: 'সবচেয়ে প্রবীণ দৌড়াচ্ছে সবচেয়ে ছোটদের জন্য! তারা যেন তার মতো দীর্ঘজীবী হয়।'
দৌড় শুরুর আগে আয়োজকরা তাকে জানিয়েছিলেন, তিনি শুধু পাতকা (যা অনেক শিখ ছেলে ও পুরুষ পরেন) পরতে পারবেন, পাগড়ি নয়।
তিনি বলেছিলেন, 'আমি পাগড়ি ছাড়া দৌড়াবো না।' শেষ পর্যন্ত আয়োজকরা তাকে পাগড়ি পরে দৌড়ানোর অনুমতি দেয়। তার মতে, এটাই তার সবচেয়ে বড় অর্জন।
তিনি ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিটে দৌড় শেষ করেন — যা তার অসাধারণ যাত্রার শুরু কেবল।
তৃতীয়বার লন্ডন ম্যারাথনে অংশ নেওয়ার সময় ফৌজা সিং তার আগের সেরা সময় থেকে নয় মিনিট কম সময়ে দৌড় শেষ করেছিলেন।
২০০৩ সালে টরন্টো ওয়াটারফ্রন্ট ম্যারাথনে তিনি আরও বড় চমক দেখান — আগের রেকর্ডের চেয়ে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট কম সময়ে দৌড় শেষ করেন। সেই দৌড় শেষ করতে তার সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা ৪০ মিনিট।

তিনি জুন মাসে বলেছিলেন, 'আমি আমার টাইমিং মনে রাখি না; আমার কোচ হরমন্দর সিং সব রেকর্ড রাখেন। তবে আমি যা কিছু অর্জন করেছি, সবই তার প্রশিক্ষণের কারণে — আর আমি মনেপ্রাণে তার শিডিউল মেনে চলেছি।'
তিনি আরও বলেছেন, 'লন্ডনে কোচ আমাকে উঁচু রাস্তায় দৌড়াতে বলতেন, আর এজন্যই আমার দক্ষতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। প্রায় প্রতিটি অনুশীলন সেশনের পর আমি গুরুদুয়ারায় যেতাম — সেখানে আমার খাদ্যতালিকার যত্ন নেওয়া হতো। সবাই আমাকে দীর্ঘ দৌড়ের জন্য অনুপ্রাণিত করত।'
২০০৪ সালে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পান, যখন অ্যাডিডাস তাকে তাদের 'ইমপসিবল ইজ নাথিং' বিজ্ঞাপন প্রচারণার জন্য চুক্তিবদ্ধ করে — সেই ক্যাম্পেইনে কিংবদন্তি মুহাম্মদ আলী-ও ছিলেন।
২০০৫ সালে তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লাহোর ম্যারাথনের উদ্বোধনী আয়োজনে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পরের বছর, ২০০৬ সালে, তিনি রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ-এর বিশেষ আমন্ত্রণে বাকিংহাম প্যালেস ঘুরে আসেন।
পাঞ্জাবে ফৌজা সিংয়ের বাড়িতে তার বহু স্মারক ও সনদপত্রের মধ্যে একটি ফ্রেম করা ছবি আছে — যেখানে তিনি রানীর সাথে রয়েছেন।
তিনি শতবর্ষ অতিক্রম করেও ম্যারাথনে অংশ নিয়ে গিয়েছেন এবং এর ফলে তিনি 'টার্বানড টর্নেডো' নামে পরিচিত হন। বিজ্ঞাপন থেকে আয় হওয়া অর্থের বেশিরভাগই তিনি দাতব্য সংস্থায় দান করতেন।
তিনি স্মরণ করে বলেছেন, 'দৌড়ানোর জগতে প্রবেশের আগেও আমি একই ফৌজা সিং ছিলাম — তবে দৌড় আমার জীবনে একটি মিশন এনে দেয় এবং আমাকে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি এনে দেয়।'
২০১৩ সালে, তিনি হংকংয়ে নিজের শেষ দীর্ঘদৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন — সেখানে তিনি ১০ কিলোমিটার দৌড় শেষ করেন এক ঘণ্টা ৩২ মিনিট ২৮ সেকেন্ডে।
তিনি সবসময়ই নিজের ভাল স্বাস্থ্যের এবং দীর্ঘায়ুর রহস্য হিসেবে সহজ জীবনযাপন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসকে কৃতিত্ব দিতেন।
তিনি জুন মাসে বলেছিলেন, 'কম খাওয়া, বেশি দৌড়ানো এবং সুখী থাকা — এটাই আমার দীর্ঘায়ুর গোপন রহস্য। এটা আমার সবার জন্য বার্তা।'
তার শেষ বছরগুলোতে সিং ভারত এবং যুক্তরাজ্যে থেকে কাটিয়েছেন।
বিবিসি যখন জুনে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছিল, তখন তিনি আশা করেছিলেন শীঘ্রই আবার লন্ডনে গিয়ে তার পরিবার ও কোচের সঙ্গে দেখা করবেন।
ব্রিটিশ এমপি প্রীত কৌর গিল এক ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, 'একজন সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক মানুষ। তার শৃঙ্খলা, সহজ জীবনযাপন এবং গভীর বিনয় আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।'
অন্য এমপি জাস আথওয়াল লিখেছেন, 'তিনি সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার মনোবল ও স্থিতিস্থাপকতার উত্তরাধিকার হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।'