দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধে নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কাজ চলছে

সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে জাতিসংঘ অনুমোদিত 'সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ' (নিরাপদ সড়ক কাঠামো) অনুসরণ করে একটি নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কাজ করছে সরকার।
প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নতুন আইনের খসড়া প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে। এতে সেফ সিস্টেম মডেলের পাঁচটি মূল স্তম্ভ—নিরাপদ মানুষ, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ গতি এবং দুর্ঘটনার পর করণীয়—এই বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই আইন কার্যকর হলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ও আহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। একইসঙ্গে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের ওপর আর্থিক চাপও অনেকটা কমে আসবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র অনুযায়ী, সংস্থাটির রোড সেফটি উইংয়ের পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি কমিটি বেশ কিছুদিন ধরে আইন প্রণয়নের কাজ করছে।
ইতোমধ্যে কমিটি প্রাথমিক একটি খসড়া তৈরি করেছে, যা বর্তমানে কমিটির সদস্যরা পর্যালোচনা করছেন।
খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ অনেক দিন ধরেই করছি। সম্প্রতি সরকার নতুন কিছু গাইডলাইন দিয়েছে, সেগুলো আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি। খসড়ার কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে, খুব শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে যে সড়ক আইন রয়েছে, তাতে গতি নিয়ন্ত্রণ, পথচারীর সুরক্ষা, দুর্ঘটনার পরের করণীয়—এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। নতুন আইনে এসব বিষয় যুক্ত হচ্ছে, বিশেষ করে রোড সেফটি অ্যাপ্রোচের পাঁচটি স্তম্ভকে ভিত্তি ধরে আইনটির কাঠামো গঠন করা হয়েছে।'
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স অন রোড সেফটি অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহায়ন, গণপূর্ত ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ঘোষণা করেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হবে।
কনফারেন্সে তিনি বলেন, সরকার ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। একইসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৬ সালের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভিত্তিক রোড সেফটি ডেটাবেজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ কী?
সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ অনুযায়ী, মানুষ ভুল করবেই, কিন্তু সেই ভুল যেন প্রাণঘাতী না হয়, সেটি নিশ্চিত করাই এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য।
এই পদ্ধতিতে সড়কের নকশা, যানবাহনের মান, চালক ও পথচারীর আচরণ, গতি নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ঘটনার পর জরুরি সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা—সবকিছুকে সমন্বিতভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। ফলে চালকের পাশাপাশি প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইন প্রয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়িত্বও স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়।
যেসব দেশে এই মডেল বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেখানে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া গেছে।
গতি নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের রোড সেফটি ইনজুরি অ্যান্ড প্রিভেনশন প্রোগ্রামের উপদেষ্টা এবং নিটোরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল আউয়াল রিজভী বলেন, 'গতি নিয়ন্ত্রণ হলো সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। গবেষণায় দেখা গেছে, যানবাহনের গতি ১ শতাংশ কমলে সাধারণ আঘাত ২ শতাংশ, গুরুতর আঘাত ৩ শতাংশ এবং প্রাণহানির আশঙ্কা ৪ শতাংশ কমে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি কোনো যানবাহনের গতি ৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা হয়, তবে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে প্রায় ৭৫ শতাংশ। কিন্তু গতি যদি ৫১ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যায়।'
নতুন আইনের আর্থিক প্রভাব তুলে ধরে ডা. রিজভী বলেন, 'একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে ছাড়পত্র পাওয়া রোগীদের মধ্যে ২২.৮ শতাংশ পথচারী এবং ৪.২ শতাংশ সাইকেল আরোহী।'
তিনি বলেন, 'এরা গড়ে ৯ থেকে ১১ দিন হাসপাতালে অবস্থান করেছে। এতে প্রতিজনের ১৮ হাজার থেকে ২৭ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। এটি নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য বড় একটি আর্থিক বোঝা।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি এই আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে শুধু প্রাণহানিই নয়, দেশের আর্থিক ক্ষতিও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।'
নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর পরবর্তী কার্যক্রম জানতে বিআরটিএ'র রোড সেফটি উইংয়ের পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন কিংবা মেসেজের কোনো উত্তর দেননি এবং তার সঙ্গে অফিসেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে বিআরটিএ'র এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, খসড়াটি চূড়ান্ত হলে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে পর্যালোচনার পর আরও কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটি অধ্যাদেশ আকারে অথবা সংসদে উত্থাপনের মাধ্যমে আইন হিসেবে পাস করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে আরও জানতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।