সংকটে স্পিনিং মিল: খাত রক্ষায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি সিদ্ধান্তের দাবি বিটিএমএর, ইয়ার্ন আমদানিতে সেফগার্ড ডিউটির আহ্বান
আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের সংকটাপন্ন টেক্সটাইল খাত, বিশেষ করে স্পিনিং মিল রক্ষায় জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটি সতর্ক করেছে, অকার্যকর নীতি ও ধারাবাহিক নিষ্ক্রিয়তা অব্যাহত থাকলে ব্যাপক হারে মিল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিটিএমএর দাবি, সরকারের বিভিন্ন সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভারতের ইয়ার্ন রপ্তানিকারকরা 'ডাম্পিং' মূল্যে বাংলাদেশে প্রতি কেজিতে ৩০ সেন্ট কম দামে ইয়ার্ন রপ্তানি করছে। এতে দেশের স্পিনিং মিলগুলো অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে।
গতকাল (২৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর গুলশান ক্লাবে আয়োজিত এক সভায় বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, খাতটি বাঁচাতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, "আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত।"
টেক্সটাইল খাত রক্ষায় আপৎকালীন পদক্ষেপ হিসেবে স্পিনিং মিলে উৎপাদিত সুতার বিক্রয়মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ উৎপাদন সহায়ক প্রণোদনা, ইয়ার্ন আমদানিতে প্রতি কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ সেন্ট সেফগার্ড ডিউটি আরোপ, লোকাল ভ্যালু অ্যাডিশন বাড়ানোর শর্ত আরোপ, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) ঋণের সীমা আগের মতো পুনর্বহাল এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, চলমান সংকটে তিনি ইতোমধ্যে তার পাঁচটি টেক্সটাইল মিলের একটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এবং এখন বাকি মিলগুলোও বন্ধ করার উপায় খুঁজছেন।
তিনি বলেন, "এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো এমন দৃশ্যও দেখা যাবে—বিটিএমএর সভাপতি, কিন্তু তার কোনো টেক্সটাইল মিল নেই।"
তিনি পরিস্থিতির জন্য ভারতের 'ডাম্পিং' নীতিকেই দায়ী করে বলেন, "অসম বাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের স্পিনিং মিলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।"
তার মতে, ইতোমধ্যে ৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও ৫০টি কারখানা স্বল্প সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কার্যত প্রায় ১০০টি টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
আমদানি তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে ইয়ার্ন আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তিনি বলেন, "২২ মাসে ভারত থেকে ইয়ার্ন আমদানি বেড়েছে ১৩৭ শতাংশ।"
খরচের চেয়েও কম দামে বিক্রি
বর্তমানে দেশে ৫০০টির বেশি ইয়ার্ন উৎপাদনকারী মিল রয়েছে। শিল্পমালিকদের ভাষ্য, অনেক মিল উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে সুতা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, ফলে আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে খাতটির সংকট তুলে ধরতে এবং তাৎক্ষণিক নীতি সহায়তার দাবিতে বিটিএমএ এ সভার আয়োজন করে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বর্তমানে স্পিনিং মিলগুলোর কাছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার অবিক্রীত ইয়ার্ন মজুত রয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে টেক্সটাইল খাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, ভারত নিজ দেশের বাজারমূল্যের চেয়েও কম দামে বাংলাদেশে ইয়ার্ন রপ্তানি করছে।
বিটিএমএর সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, "ভারত আমাদের বাজারে ভর্তুকিপ্রাপ্ত সুতা ডাম্পিং করছে। কিন্তু আমাদের দেশে কার্যকর অ্যান্টি-ডাম্পিং নীতি নেই। অন্যদিকে ভারত নিজের শিল্প রক্ষায় নানা প্রণোদনা দিচ্ছে, এমনকি গার্মেন্ট শিল্পে জমি, বিদ্যুৎ ও মজুরিতে সরাসরি ভর্তুকিও ঘোষণা করেছে।"
এ অবস্থায় টেক্সটাইল শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের বড় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এই সেক্টর এখন আইসিইউতে চলে গেছে। সেখান থেকে বের করে আনতে সরকারকে বড় পদক্ষেপ নিতে হবে।"
'ভর্তুকি নয়, টিকে থাকার প্রশ্ন'
বিটিএমএর সাবেক সভাপতি এ মতিন চৌধুরী বলেন, এই খাতে বিনিয়োগকারীরা সরকারের নীতির ওপর আস্থা রেখে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তাই নীতি এমন হতে হবে, যাতে তারা প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমান অবস্থানে থাকতে পারেন।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশ রপ্তানির স্বার্থে ডিউটি–ফ্রি আমদানি সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু প্রতিযোগী দেশগুলো রপ্তানিতে নানাভাবে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিচ্ছে। সেগুলোর বিপরীতে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে প্রতিযোগিতা অসম হয়ে পড়বে।"
তিনি আরও বলেন, যেসব ইয়ার্ন দেশে উৎপাদন করা সম্ভব, সেগুলোর আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। পাশাপাশি এই আনফেয়ার কম্পিটিশনের (অসম প্রতিযোগিতা) বিপরীতে আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা দিতে হবে।
"বিষয়টি ভর্তুকির নয়, টিকে থাকার," বলেন তিনি।
জ্বালানি ব্যয় ও আমদানি নির্ভরতা
জ্বালানি ব্যয় প্রসঙ্গে শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বৈশ্বিক বাজারে গ্যাসের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও দেশে গ্যাসের দাম কেন কমানো হচ্ছে না—সে প্রশ্ন রয়েই গেছে।
তিনি বলেন, "বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু দাম কমলে তা কমানো হয় না। বর্তমানে বৈশ্বিক বাজারে গ্যাসের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।"
তিনি সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ভবিষ্যতে দেশকে গুরুতর পরিণতির মুখে পড়তে হতে পারে। অতীতে ভারত বাংলাদেশে তুলা ও ইয়ার্ন রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার উদাহরণ তুলে ধরে তিনি আত্মনির্ভরতার ওপর জোর দেন এবং আমদানিনির্ভরতা কমানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
ভারত সুযোগ বুঝে অতীতের মতো সুতা ও তুলা রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের আরসি কোলার উদাহরণ দেন।
তিনি বলেন, "আমরা যখন আরসি কোলা কলকাতায় রপ্তানি শুরু করলাম, ১৫ দিনের মধ্যেই তারা ট্যাক্স রেট পরিবর্তন করে দিল।"
তিনি আরও বলেন, "ভারতকে বোঝাতে হবে—বন্ধুত্ব চাইলে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে; কিন্তু অতীতে সরকার ও মন্ত্রীরা তা করেননি।"
'ভারতের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের শিকার'
বিটিএমএর সাবেক সহসভাপতি রাজীব হায়দার বলেন, বাংলাদেশ ভারতের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের শিকার।
তিনি জানান, প্রতি কেজি ইয়ার্ন উৎপাদনে ভারতের প্রকৃত খরচ প্রায় ৩ ডলার হলেও তারা ২ দশমিক ৫ ডলারে রপ্তানি করছে। এর ফলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের বিদেশি ক্রেতারা ভারতীয় রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ইয়ার্ন কেনার জন্য মনোনয়ন দিচ্ছে।
তিনি বলেন, এক বছরে ভারত থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের ইয়ার্ন আমদানি হয়েছে। "আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে; এই আগ্রাসন চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটি ঠেকাতে সরকারের নীতিগত সহায়তা জরুরি।"
তার ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতের রপ্তানি হওয়া ইয়ার্নের ৪৪ শতাংশের বাজার বাংলাদেশ। বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্তভাবে ইয়ার্ন আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রস্তাবও দেন তিনি।
