বিচার বিভাগের সংস্কার থমকে, অগ্রগতির স্থবিরতায় হতাশ কমিশন
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের দেওয়া ৩০টি সুপারিশের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন গঠন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন সংশোধন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনসহ ৯টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তবে উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপন, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণ, স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের এখতিয়ার নিয়ন্ত্রণ, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা এবং বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান।
এ বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমি সন্তুষ্টও নই, অসন্তুষ্টও নই। যে যার মতো চলছে। আমার আর কোনো প্রত্যাশাও নেই, আশাও নেই।"
কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ করে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব। তবে অধিকাংশ আইনজ্ঞ ও আইনজীবী এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় সরকারিভাবে এটি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ বা আলোচনা দৃশ্যমান হয়নি।
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন কমিশনের অন্যতম সদস্য ও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলার বাদী সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন।
তিনি বলেন, "আমরা যে সুপারিশগুলো করেছিলাম, তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি বাস্তবায়ন হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনে আমাদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিএনপি ও অন্যরা আমাদের মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেনি। কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়নে সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখছে না, আবার প্রকাশ্য কোনো আপত্তিও জানাচ্ছে না।"
যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে
আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় গঠন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন গঠন, সুপ্রিম কোর্টে ইনফরমেশন ডেস্ক স্থাপন, নারী ও শিশুদের জন্য আদালতে পৃথক স্থান নির্ধারণ, আইনজীবীর বিরুদ্ধে করা মামলায় বিপক্ষের জন্য অন্য আইনজীবী নিয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রজ্ঞাপন জারি, আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের সঙ্গে মধ্যস্থতা কার্যক্রম যুক্ত করা, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন।
উল্লেখযোগ্য যেসব সুপারিশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি
বিচার বিভাগের মূল কাঠামোগত সংস্কারের বড় অংশ এখনো অচল অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণে বিধি প্রণয়ন, স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের এখতিয়ার নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক আদালত স্থাপন, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠন, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধান সংশোধন, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমাতে উদ্যোগ গ্রহণ, বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ, গ্রাম আদালত বাস্তবায়ন, আইন পেশার সংস্কার, আইন শিক্ষার সংস্কার, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে আইন সংশোধন এবং মামলাজট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে আইনজ্ঞদের আপত্তি
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ ইতিবাচক হলেও কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত কমিশনের সুপারিশকে সমর্থন করেছেন।
তিনি স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিসকেও যুগোপযোগী বলে মনে করেন। তবে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনকে তিনি 'আদালত অবমাননা' হিসেবে উল্লেখ করে সতর্ক করেন।
মনজিল মোরসেদ বলেন, "সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে একসময় বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করা হয়েছিল, কিন্তু পরে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে। এখন আবার তা করা হলে সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আমি নিজেও চ্যালেঞ্জ করতে পারি।"
একই মত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি বলেন, "বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ হতে পারে না। অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ছয় বিভাগে স্থায়ী বেঞ্চ করা হয়েছিল, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করেছে। এখন আবার করলে তা সাংবিধানিকভাবে চ্যালেঞ্জ হবে।"
সামগ্রিকভাবে কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে মন্তব্য করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন একটি মীমাংসিত বিষয়। অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট এটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছিল।
তিনি আরও বলেন, "বিভাগীয় পর্যায়ে বেঞ্চ হলে প্রধান বিচারপতির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান না থাকায় দুর্নীতি বাড়তে পারে এবং টাউট-বাটপার শ্রেণির দৌরাত্ম্য সৃষ্টি হতে পারে।"
তিনি স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেন। তবে কমিশনের অন্যান্য সুপারিশকে তিনি যথাযথ বলে মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য আইনজীবী ড. শরীফ ভুঁইয়া বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের পক্ষে মত দেন।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ চায়।
তিনি বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের ইউনিটারি সিস্টেম অক্ষুণ্ন রেখেও এটি করা সম্ভব, হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় রেখে। অর্থাৎ দেশের যেকোনো বিভাগে বসেও যে কেউ বিচার চাইতে পারবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ মামলাটি কোথায় শুনানি হওয়া উচিত, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।"
বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের পক্ষে মত দিয়েছেন আপিল বিভাগের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরও।
তিনি বলেন, "সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব। অতীতে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ছয় বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করা হয়েছিল, পরে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে। তবে মানুষের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় নিলে এটি প্রয়োজনীয়।"
তিনি আরও বলেন, "বরিশাল বা কুড়িগ্রামের একজন মানুষকে আগাম জামিন নিতে হলে ঢাকায় আসতে হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট থাকলে তিনি রংপুর বা বরিশালেই সে সুযোগ পেতেন।"
সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি 'সন্তুষ্টজনক' বললেন কমিশনের সদস্য
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সন্তুষ্টজনক বলে মন্তব্য করেছেন কমিশনের সদস্য এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল কনসালটেন্ট ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন হোসেন শাওন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "গুরুত্বপূর্ণ অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগে আইন ও স্বতন্ত্র সচিবালয় আইন কার্যকর হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন পৃথক করা হয়েছে, অধস্তন আদালতে পদ সৃষ্টির ক্ষমতা বিচার বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক আদালত অধ্যাদেশ অনুমোদিত হয়েছে এবং আইনগত সহায়তা অধ্যাদেশে দুই দফা সংশোধন আনা হয়েছে। এগুলো সরকারের ভালো পদক্ষেপ।"
তিনি আরও বলেন, "স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের প্রতিবেদনের প্রতিটি অধ্যায়ে বহু সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সুপারিশ জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।"
ব্যারিস্টার শাওন বলেন, এই সরকার কিছু ভৌত অবকাঠামোর কাজ শুরু করতে পারবে, তবে শেষ করতে পারবে না। এর মধ্যে ঢাকা কোর্ট ভবন সংস্কারের কাজ রয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে মামলা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কমিশনের অনেক সুপারিশ থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্ট যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি।
তিনি বলেন, প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশনের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট যৌথভাবে পর্যালোচনা করলে বাস্তবায়নের গতি আরও বাড়তে পারত। তবে যতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তাতে তিনি অনেকটাই সন্তুষ্ট।
বিচার বিভাগ সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি কমিশন গঠন করা হয়। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কমিশনের কার্যক্রম শেষ হয়। অংশীজন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর কমিশন মোট ৩০টি সংস্কার প্রস্তাব দেয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৩৫২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিবেদনটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে।
