অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ ও গঠন প্রক্রিয়া বৈধ: আপিল বিভাগ
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন ও শপথ প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট খারিজের যে আদেশ হাইকোর্ট দিয়েছিলেন, তা বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রিটকারীর করা লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত এই রায় দেন। অর্থাৎ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ ও গঠন প্রক্রিয়া বৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সময় সরকার গঠন ও শপথের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স ও মতামত চাওয়া হয়েছিল। এই রেফারেন্স মতামত প্রক্রিয়া ও সরকারের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। হাইকোর্ট সেই রিট খারিজ করে দেন।
পরবর্তীতে হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন রিটকারী। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) এই আবেদনের ওপর শুনানি শেষ হয় এবং আদালত রায়ের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আপিল বিভাগ রিটকারীর আবেদনটি খারিজ করে রায় ঘোষণা করলেন।
আদেশে আপিল বিভাগ বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ ও গঠন প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট খারিজের হাইকোর্টের আদেশ সঠিক ও যথার্থ। আপিল বিভাগ এ কারণে হাইকোর্টের আদেশে হস্তক্ষেপ করছেন না। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে এ আদেশ দিয়েছেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক। রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ। ইন্টারভেনর হিসেবে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এস এম শাহরিয়ার কবির।
রায়ের পর শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগের আজকের আদেশের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন প্রক্রিয়া ও কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ থাকল না।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও শপথ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঠানো রেফারেন্স ও মতামতের প্রক্রিয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ গত বছরের ডিসেম্বরে রিট করেন। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৩ জানুয়ারি রিটটি সরাসরি খারিজ করে আদেশ দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ।
লিভ টু আপিলের ওপর গত ২ নভেম্বর শুনানি শুরু হয়। এরপর ৬ নভেম্বর শুনানি নিয়ে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়। ১২ নভেম্বর বিষয়টি শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন আদালত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। এর ধারাবাহিকতায় গত গত মঙ্গলবার ও বুধবার শুনানি হয়।
আদালতে লিভ টু আপিলকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মহসিন রশিদ নিজে শুনানি করেন। এই মামলায় ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হন লেখক ফিরোজ আহমেদ, যিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ছিলেন। আদালতে তার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। এ মামলায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ইন্টারভেনার হন। জ্যেষ্ঠ এই দুই আইনজীবীও শুনানিতে অংশ নেন।
লিভ টু আপিলে নওগাঁর বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হন। তার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ এস এম শাহরিয়ার কবির।
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক শুনানিতে অংশ নেন।
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে তিনটি ম্যান্ডেট—নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার-সংক্রান্ত বৈধতার ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো.আসাদুজ্জামান বলেন, 'আজকে আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে বলেছেন, তারা হাইকোর্টের রায়ের মধ্যে কোনো ভ্রান্তি, ভুল, বেআইনি কিছু পাননি। সুতরাং লিভ টু আপিল পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ কী, এটা আমরা এখনো হাতে পাইনি।'
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, 'আদেশের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে রিটের কোনো সারবত্তা থাকল না। প্রকারান্তরে অন্তর্বর্তী সরকার যে পরিচালিত হচ্ছে জনগণের মতামতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে, সেটাই স্থাপিত হলো।'
মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, 'এই আদেশটি সর্বসম্মতিতে হয়েছে। এই আদেশের ফলে এটি প্রতিষ্ঠিত হলো যে, বর্তমান সরকার জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গঠিত সরকার। উইল অভ দ্য পিপল। এই সরকার যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, তা মূলত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের উচ্চ আদালত দেশের সংবিধানের এই মূলমন্ত্র আজ আবার পুনর্ব্যক্ত করলেন। এই আদেশের ফলে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে তিনটি ম্যান্ডেট-নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার-সম্পর্কিত বৈধতার ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।'
