ঝুঁকিপূর্ণ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে: রেলপথ পুনর্বাসন ও রক্ষণাবেক্ষণে ২,১১৯ কোটি টাকার প্রকল্প
পশ্চিমাঞ্চলের ৪৪৯ কিলোমিটার রেলপথ এবং ৫১৪ কিলোমিটার ট্র্যাকের পুনর্বাসন ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে ২ হাজার ১১৯ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে প্রথম ধাপের এই প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
গত ১৫ বছরে ৯৪৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মিত হলেও বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধশত বছরের পুরনো রেল ও ট্র্যাকগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়নি সরকার। ফলে পশ্চিমাঞ্চলের রেলগুলো ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, প্রতিনিয়ত ফাটল ও রেল ভেঙে পড়ার মতো ঘটনার পাশাপাশি স্লিপারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভেঙে গেছে।
রেল কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সেকশনগুলোতে প্রায় ২৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ অকেজো বা ভাঙা স্লিপার রয়েছে। দিন দিন এ হার বাড়ছে। প্রায় সব সেকশনে ব্যালাস্টের তীব্র ঘাটতি রয়েছে। এতে ট্র্যাকের ভারসাম্য, গেজ, অ্যালাইনমেন্ট রক্ষা করা যাচ্ছে না। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝূঁকি।
মূলত দীর্ঘদিনের এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই প্রস্তাবিত প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে পশ্চিমাঞ্চলের ১ হাজার ৯৩১ কিলোমিটার রুট ও ২ হাজার ৫০৫ কিলোমিটার ট্র্যাক পুনর্বাসন ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে বিপুল পরিমাণ অর্থায়নের প্রয়োজন হওয়ায় রেলপথ মন্ত্রণালয় কয়েক ধাপে কাজটি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আহমেদ হোসেন মাসুম জানান, বর্তমানে ৪৪৯ কিলোমিটার রেলপথ এবং ৫১৪ কিলোমিটার ট্র্যাক পুনর্বাসন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে।
২ হাজার ১১৯ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-ইব্রাহিমাবাদ, সয়দাবাদ-ঈশ্বরদী বাইপাস, ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী বাইপাস, ঈশ্বরদী-সৈয়দপুর ও আব্দুলপুর-রাজশাহী কোর্ট অংশ পুনর্বাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় প্রকল্পটিকে 'অত্যাবশক' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ট্র্যাক পুনর্বাসনের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পঞ্চিমাঞ্চলের রেলপথগুলোর বেশিরভাগই প্রায় শতবর্ষের পুরনো। বর্তমানে এগুলোর ক্ষয় হওয়ার হার ১২ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে তা আরও বাড়ছে। এর ফলে প্রায়ই লাইনে ফাটল দেখা দিচ্ছে, ওয়েল্ডিং জয়েন্টগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এবং রেল ভেঙে পড়ছে। এরকম ত্রুটির কারণে নিরাপদ ট্রেন চলাচল মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, সৈয়দপুর-জয়দেবপুর সেকশনটি ২০০০-০১ সালে পুরনো রেল দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু এই সেকশনে সেকশনাল ক্যাপাসিটির চেয়ে অধিক সংখ্যক ট্রেন চলাচলের কারণে রেল, স্লিপার ও ফিটিংসের আয়ু দ্রুত কমে গেছে।
প্রধান প্রকৌশলী বলেন, 'বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন (১ম পর্যায়)' শিরোনামে রেলরুট ও ট্র্যাক পুনর্বাসনের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। কমিশন ইতিমধ্যে সভা করে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের জন্য অনুমোদন করেছে। প্রকল্পের জনবল বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া গেলেই এটি একনেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উঠবে।
পশ্চিমাঞ্চলে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামাল দিতে দুর্বল রেলপথে সক্ষমতার বেশি ট্রেন চালানোর ফলে ট্র্যাকের ভারসাম্য, গেজ ও অ্যালাইনমেন্ট ঠিক রাখা যাচ্ছে না। ফলে অনেক স্থানে নিয়ন্ত্রিত গতিতে চলছে ট্রেন, যা যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের মান কমাচ্ছে।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আটটি নতুন রেলপথ নির্মাণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এসব রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। অথচ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের রুট ও ট্র্যাক পুনর্বাসনে প্রতিব ছর ১৫০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন হলেও বরাদ্দ পাওয়া যেত চাহিদার চেয়েও ১০০ কোটি টাকা কম।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আহম্মদ হোসেন মাসুম বুধবার টিবিএসকে বলেন, রেলপথ ও ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য বিগত বছরগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ না পাওয়ায় রেললাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে মাত্র ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণের বাজেট সীমিত থাকায় বিগত বছরগুলোতে পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত রেল, অকেজো স্লিপার, ব্যালাস্টের ঘাটতি, টেম্পিং ও লাইনের ভারসাম্যহীনতা বেড়েছে। এতে রেলপথ দ্রুত ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং বিদ্যমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সেকশনগুলো দিয়ে ট্রেন চলাচল কঠিন হয়ে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন কর্মকর্তারা।
রেলপথের এই নাজুক অবস্থা সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের এসব রেলপথ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার অন্ত নেই। পঞ্চিমাঞ্চলের রেলপথের মাধ্যমেই ভারতীয় রেলওয়ের সঙ্গে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের পরিকল্পনা রয়েছে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক (টিএআর), সার্ক নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার ফোরাম ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (বিসিআইএম), বে অভ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) ও বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল-এর (বিবিআইএন) অধীনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আঞ্চলিক সংযোগ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
পঞ্চিমাঞ্চলের রেলপথগুলোর বেশিরভাগই প্রায় একশো বছরের পুরনো। দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে ১৮৬২ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৭৪ সালে পাকশি থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত মিটারগেজ লাইন নির্মাণের পর ১৯২৪ সালে তা ব্রডগেজে রূপান্তর করা হয়। পাকশি থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হয় ১৯১৫ সালে।
এছাড়া সান্তাহার-ফুলছড়ি ঘাট সেকশনের রেলপথ নির্মিত হয় ১৮৯৯ সালে এবং কাউনিয়া-বোনারপাড়া সেকশন চালু হয় ১৯০৫ সালে। ২০০৩ সালে পার্বতীপুর থেকে জামতৈল পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইনটিকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর সম্পন্ন হয় এবং যমুনা সেতুর পূর্ব থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ লাইন স্থাপন করা হয়।
