চট্টগ্রাম-১: পুরোনো দুর্গ পুনরুদ্ধারে বিএনপি, বিবাদ কাজে লাগাতে চায় জামায়াত
চট্টগ্রাম উত্তর জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) সংসদীয় আসন। দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই আসনটি এখন নিজেদের ঘরে তুলতে মরিয়া একসময়ের দুই মিত্র—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে দৃশ্যত বিতাড়িত হওয়ায় এবং তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে আসনটি পুনরুদ্ধারে বিএনপির সামনে বড় সুযোগ এলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চরম অভ্যন্তরীণ কোন্দল। অন্যদিকে, প্রায় এক বছর ধরে একক প্রার্থী নিয়ে মাঠে সক্রিয় জামায়াত ইসলামী চায় বিএনপির এই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয় পেতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত এই আসনে এবার ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিন। তবে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পরও স্থানীয় বিএনপিতে অসন্তোষ থামেনি। মনোনয়ন পরিবর্তন চেয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছেন দলের ১১ জন জ্যেষ্ঠ নেতা।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন দলটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার মজলিশে শূরার সদস্য ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান। এ ছাড়া এনসিপির মনোনয়ন নিয়ে আলোচনায় আছেন ব্যবসায়ী শাহ পরাণ।
বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে তুমুল বিরোধ
২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী ছিলেন নুরুল আমিন। এবারও তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষুব্ধ দলের একটি বড় অংশ। আসনটিতে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরও ছিলেন জেলা শাখার আরেক সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন (দ্বৈত নাম), উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী ও ব্যবসায়ী নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।
মনোনয়নকেন্দ্রিক বিরোধের বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করা সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, তিন ইউনিটের আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ সবাই মিলে দলকে চিঠি দিয়েছি। দল তিনটি কমিটি দিয়ে তদন্ত করে তাকে (নুরুল আমিন) বহিষ্কার করেছিল। এরপর দল আবার তাকেই প্রার্থী করেছে। ফলে আমরা জনগণের কাছে ধানের শীষের ভোট চাইতে গিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হবো। দল বলেছিল, এটি পরিবর্তনও হতে পারে। এজন্য আমরা দলের কাছে আবেদন জানিয়েছি।'
তবে কোন্দল নিরসনের বিষয়ে আশাবাদী বিএনপির প্রার্থী নুরুল আমিন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অনেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। দল সবকিছু বিবেচনা করে আমাকে প্রার্থী করেছে। এখানে ধানের শীষের মালিক আমি একা নই। খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ধানের শীষের মালিক।'
অন্যান্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'হয়তো তারা ব্যক্তিগত কারণে সাড়া দেননি। আমি আশা করছি, অল্প সময়ের মধ্যে সবাই ধানের শীষের জন্য কাজ করবে। তা দ্রুত দৃশ্যমান হবে।'
সুসংহত অবস্থানে জামায়াত
বিএনপির গৃহদাহের বিপরীতে বেশ ফুরফুরে অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে দলটি। দলটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার মজলিশে সূরার সদস্য ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমান মিরসরাইয়ের প্রতিটি প্রান্তে চষে বেড়াচ্ছেন।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে তাদের ভোটব্যাংকে ধস নেমেছে বলে মনে করেন জামায়াতের প্রার্থী সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, '৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপির দলীয় কোন্দলে ১২টি খুন হয়েছে, যারা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। বহিষ্কার হওয়া নেতাকে প্রার্থী করা নিয়ে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে। আমি মনে করি, আগের মতো তাদের ভোট ব্যাংক নেই। দিনে দিনে তা কমে আসছে।'
নিজের অবস্থান তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, "নারী ও অমুসলিম ভোটারদের কাছে বিভিন্ন ফরমেটে আমরা যাচ্ছি এবং সাড়া পাচ্ছি। আর আমি মিরসরাইয়ের সন্তান হিসেবে সব শ্রেণির মানুষের আইনজীবী ছিলাম। মানুষ আমাকে গ্রহণ করছেন।"
মাঠের অন্য প্রার্থীরা
প্রধান দুই দলের বাইরে এনসিপির উত্তর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দিন, ব্যবসায়ী শাহ পরাণ এবং ইসলামী আন্দোলনের হয়ে ফেরদৌস আহমদ চৌধুরীও মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।
ভোটের পরিসংখ্যান ও একসময়ের দুর্গ
মিরসরাই আসনটি একসময় বিএনপির শক্ত ঘাঁটি বা দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি ও জুন) এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এখানে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হন। তবে ১৯৯৬ সালের উপনির্বাচন এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে যায়। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোতেও আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ৫২.৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। সেবার ধানের শীষের প্রার্থী এমডিএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী পেয়েছিলেন ৪৭ শতাংশ ভোট। বাকি প্রার্থীরা এক শতাংশের কম ভোট পান। মোট ভোট পড়েছিল এক লাখ ৭৯ হাজার ৭৬৩টি। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন মোশাররফ।
২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ ৯৬.৭৯ শতাংশ ভোট পান, যেখানে বিএনপির নুরুল আমিন পান মাত্র ১.৪৫ শতাংশ ভোট। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের ছেলে মাহবুবুর রহমান রুহেল।
দলীয় কোন্দল ও নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, 'বড় দল হিসেবে অনেক যোগ্য লোক প্রার্থী হতে চেয়েছেন। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিভাজন কমে আসবে। সামনে বিরোধ থাকবে না।'
