আসন সমঝোতায় দেরিতে ক্ষুব্ধ বিএনপি শরিকরা, দ্রুত সিদ্ধান্তের দাবি
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৭২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। তবে জোট শরিকদের জন্য আসন ছাড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো স্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেয়নি দলটি।
ফলে ভোটের মাঠে বিরোধী দলের প্রার্থীদের তুলনায় প্রচারে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে বলে মনে করছেন শরিক নেতারা। তাদের মতে, দ্রুত আসন-সমঝোতা না হলে শরিকদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব বাড়তে পারে। এতে ভবিষ্যৎ রাজনীতি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে দ্রুত আসন সমঝোতার দাবি তুলেছেন সমমনা নেতারা।
নতুন করে ঘোষিত ৩৬ আসনের তালিকায় বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র অন্তত পাঁচ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ কারণে জোটের বেশ কয়েকজন ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
কেউ কেউ বিএনপি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছর 'ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা'র পতনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। আর এদিকে, আলোচনায় না বসেই বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
এদিকে এখনো ২৮টি আসন ফাঁকা রেখেছে দলটি। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, এসব আসনের মধ্যে ২০টির মতো যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে দেয়া হতে পারে। বাকি আসনে নির্বাচনী পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ফাঁকা থাকা আসনের মধ্যে কয়েকটি নিয়ে বিরোধও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি সপ্তাহেই শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, "সমমনাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা তাদের সমর্থন দেবো। তারা যেসব আসনে প্রার্থী দেবেন, সেখানে আমরা প্রার্থী দেবো না। আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত হবে।"
শরিকদের জন্য আসন ফাঁকা
কিছু আসনে সমমনাদের সবুজ সংকেত দিয়েছে বিএনপি। এসব আসনের মধ্যে রয়েছে—পিরোজপুর-১ এ জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার; ঢাকা-১৩ এ এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ; ঢাকা-১৭ এ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ; লক্ষ্মীপুর-১ এ এলডিপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম; বগুড়া-২ এ নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না; ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ এ গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি; চট্টগ্রাম-১৪ এ এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক; কুমিল্লা-৭ এ দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ; পটুয়াখালী-৩ এ গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর; ঝিনাইদহ-২ এ গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান।
ঘোষিত ২৭২টি আসনের তালিকায় এই ১০ আসনে কাউকে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। কয়েকজনকে জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তুতিও চলছে বলে জানা গেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, এদের সবারই জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সমঝোতা সাপেক্ষে এনসিপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টার জন্য ঢাকায় কয়েকটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছিল। তবে সমঝোতা না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় ঢাকার চারটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি।
সমমনাদের ৪ নেতা মনোনয়নবঞ্চিত
নতুন করে ঘোষিত ৩৬ আসনের মধ্যে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র তিন দলের অন্তত পাঁচজন নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে রয়েছেন ১২-দলীয় জোটের শরিক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। এর আগে, তাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিল বিএনপি, এমনকি স্থানীয় নেতাকর্মীদের সহযোগিতার জন্য দলীয় চিঠিও দেওয়া হয়েছিল।
নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি এ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনও করেছিলেন। এবারও তার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন এনপিপির নেতা-কর্মীরা।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ঝালকাঠি-১ আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী ঢাকা-৬ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ২০১৮ সালে তাকে এ আসন ছাড় দিয়েছিল বিএনপি। এবার আলোচনা ছিল ঢাকা-৭ আসন তাকে দেওয়া হতে পারে— কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই আসনে বিএনপি হামিদুর রহমানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
মনোনয়নবঞ্চনার পর বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ ২০ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান অভিযোগ করেন, বিএনপি শরিকদের প্রতি 'অবজ্ঞা', 'অসম্মান' ও 'বেইমানিপূর্ণ আচরণ' করেছে।
তিনি বলেন, "বিএনপি দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক ভ্রাতৃত্ব, যৌথ সংগ্রাম ও মিত্রতার সম্পর্ককে অবজ্ঞা করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং শরিকদের মাইনাস করে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে— যা রীতিমতো প্রতারণামূলক, অমর্যাদাকর ও বেঈমানি।"
নতুন জোট গঠনের চেষ্টা
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন করেছে পাঁচদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। তবে সভাপতি আ স ম আবদুর রব শারীরিক অসুস্থতার কারণে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। তার স্ত্রী ও জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আসনটি এখনো ফাঁকা থাকলেও হেভিওয়েট প্রার্থী থাকায় বিএনপি তা ছাড়তে আগ্রহী নয়। ফলে জেএসডি এখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও এবি পার্টির সঙ্গে নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে।
অন্যদিকে আলোচনা রয়েছে—সিলেট-৫ আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের আমির উবায়দুল্লাহ ফারুক, নীলফামারী-১ এ মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ এ সহ-সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, নারায়ণগঞ্জ-৪ এ কেন্দ্রীয় নেতা মনির হোসেন কাসেমী, নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনে গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট একেএম জগলুল হায়দার আফ্রিক।
এসব আসনে বিএনপি এখনো কাউকে প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
