বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা: বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ
ঢাকার কাছে নরসিংদীর মাধবদীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপন্ন ভূমিকম্পের পর এটি বাংলাদেশের প্রত্যেক প্রতিটি মানুষের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় আকারের ভূমিকম্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কতটুকু সহনশীল হবে এবং আগেও ভূমিকম্পের ইতিহাস থাকায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপট এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রিফাত উর রহমান কথা বলেন দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড-এর সঙ্গে।
বাংলাদেশের এই অঞ্চলটাকে ভূতাত্ত্বিকভাবে আমরা কীভাবে দেখতে পারি? বেঙ্গল বেসিন বা জিবি ডেল্টা বলতে আসলে কী বোঝায়?
বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলকে ভূতাত্ত্বিকভাবে বেঙ্গল বেসিন নামে অভিহিত করা হয়। এটি মূলত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ডেল্টা অঞ্চলের সমন্বয়ে গঠিত। অতীতে এই অঞ্চলের প্রধান নদী ছিল গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। এদের সাথে আরও অনেক ছোট নদী বা ট্রিবিউটারি শাখা যুক্ত ছিল। যদিও শাখাপ্রশাখার সংখ্যা অনেক ছিল, তবুও প্রধান জলপ্রবাহ হিসেবে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রই অঞ্চলটিকে আকার দিয়েছিল।
ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি মানচিত্রগুলোতে ১৭৭০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে একাধিক বড় ভূমিকম্পের তথ্য পাওয়া যায়। এই ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে কিছু নদীর গতিপথ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যেমন, ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নামে নতুন নদীর জন্ম দেয়। এসব নথি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত যে, এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক কাঠামো ও টেকটনিক প্লেটগুলো ক্রমাগত গতিশীল এবং সক্রিয়।
বাংলাদেশের টেকটনিক প্লেটগুলোর মধ্যে দুটি বিশেষভাবে সক্রিয়: ক. সিলেট জোন: ডাউকি সীমান্ত থেকে সিলেট হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত। খ. রাজশাহী জোন: রাজশাহী ও আশেপাশের অঞ্চলে অবস্থিত।
এই সক্রিয় ফাটল ও প্লেট মুভমেন্টের কারণে এই অঞ্চলটি ভূমিকম্প প্রবণ। অতীতের নথি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বাংলাদেশে ভূমিকম্প একটি সম্ভাব্য ঘটনা এবং এর মাত্রা নির্দিষ্টভাবে পূর্বাভাস করা যায় না।
ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো প্রমাণ আছে কি?
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৭৭০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্প ঘটেছে। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্র ও নথি থেকে দেখা যায়, এই ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে কিছু নদীর পথ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রহ্মপুত্রের শাখা পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নামে নতুন নদীর জন্ম হয়। এ ধরনের ঘটনা আমাদের সতর্ক করে যে, বাংলাদেশের টেকটনিক কাঠামো বহু শতাব্দী ধরে সক্রিয় রয়েছে এবং এই প্রক্রিয়াটি এখনো চলমান।
সাম্প্রতিক ঢাকার ভূমিকম্পকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এটি কি আমাদের জন্য নতুন কোনো সতর্কবার্তা?
ঢাকায় সাম্প্রতিক ভূমিকম্প আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। এই ধরনের ভূমিকম্প, যা সম্প্রতি ঘটেছে, আমি ৪৫ বছরের জীবনে আগে কখনো লক্ষ করিনি। এটি আমাদেরকে ইঙ্গিত দেয় যে, ভূমিকম্পের প্রভাব এই অঞ্চলে এখনো শক্তিশালী এবং যেকোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদেরকে শুধু অতীতের তথ্যের উপর ভরসা না রেখে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতের জন্যও প্রস্তুতি নিতে হবে।
ভূমিকম্প তো থামানো যাবে না, তাহলে বাস্তবিক প্রস্তুতির দিক থেকে কী করা জরুরি?
ভূমিকম্পকে থামানো সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কোনো প্রযুক্তি নেই যা ভূমিকম্পকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করতে পারে। তবে আমরা যে কাজটি করতে পারি, তা হলো ভূমিকম্পের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ।
বর্তমানে আমাদের দেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো ধারাবাহিক ট্রেনিং নেই যে কীভাবে ভূমিকম্পের সময় নিরাপদে থাকা যায়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা নেই, ফলে যারা কোনো বিল্ডিং বা হাই-রাইজে অবস্থান করে, তারা ধ্বংস বা ধসের সময় আহত হতে পারে। আমাদের অবশ্যই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিল, কারখানা ও পাবলিক স্পেসে নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও অব্যাহত ট্রেনিং চালু করতে হবে।
এছাড়াও, ভবনের কাঠামো পুনর্নির্মাণ, শক্তিশালী নির্মাণ নীতি এবং পুরনো বা ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংকে পুনর্বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
খনিজ সম্পদ উত্তোলন, গ্যাস ও কয়লাখনি কার্যক্রমের সঙ্গে ভূমিকম্প বা আফটারশকের ঝুঁকির কোনো সম্পর্ক আছে কি?
হ্যাঁ, খনিজ ও খনি সম্পদ উত্তোলনের সঙ্গে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কিছুটা সম্পর্কিত। আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় খনিজ সম্পদ, কয়লা ও গ্যাস উত্তোলন চলছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, ভূমিকম্পের পর আফটারশক ঘটার সম্ভাবনা থাকে এবং কখনো কখনো এই আফটারশকের মাত্রা মূল ভূমিকম্পের চেয়ে বেশি হতে পারে। তাই গুরুত্বপূর্ণ খনি বা গ্যাস উত্তোলন কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা এবং নিরাপত্তা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
শুধু সচেতনতা কি যথেষ্ট, নাকি ভূমিকম্পের সময় করণীয় শেখানোর মতো ধারাবাহিক উদ্যোগও দরকার?
শুধু সচেতনতা যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে ধারাবাহিকভাবে ভূমিকম্প চলাকালীন করণীয় কার্যক্রম শেখাতে হবে। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া ও পাবলিক ইভেন্টে এই বিষয়গুলো নিয়মিত তুলে ধরা উচিত। উদাহরণস্বরূপ: বাচ্চারা কোথায় দাঁড়াবে, কোথায় নিরাপদ। বড়রা কীভাবে নিজেদের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, ভবন বা ঘর ধসের আগে কী কী প্রস্তুতি নেওয়া যায়।
বর্তমানে আমরা ভূমিকম্পের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখি, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে ভুলে যাই। এ ধরনের ধারাবাহিক সচেতনতা, ট্রেনিং এবং প্র্যাকটিস অত্যন্ত জরুরি।
ভূমিকম্পের সময় আমাদের মানসিকতা কেমন হওয়া উচিত?
ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক, তবে আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। অতীত ও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে এই অঞ্চলটি ভূমিকম্পপ্রবণ। তাই আমাদের মানসিকভাবে স্বীকার করতে হবে যে ভূমিকম্প ঘটবেই এবং সেই অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সচেতনতা তৈরি রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও মিল-কারখানাগুলো চালু থাকে। আপনি এই বৈষম্যটাকে কীভাবে দেখেন? ঝুঁকি কি শুধু শিক্ষার্থীদের, শ্রমিকদের নয়?
সব জীবনই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুধু শিক্ষার্থীদের জীবনকে গুরুত্ব দিই, কেননা তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকরা, মিলের কর্মচারী বা অন্যান্য মানুষও সমানভাবে ঝুঁকির মুখোমুখি। কলকারখানা ও শিল্পস্থলে কয়েক দিনের জন্য নিরাপত্তা পরিদর্শন ও ইন্সপেকশন চালানো উচিত। ফাটল বা ক্র্যাক থাকলে তা মেরামত করতে হবে এবং জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটি শ্রমিকদের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্বকেও নিশ্চিত করবে।
