কক্সবাজার রেলরুটে গতি আনতে নেওয়া ২১,০০০ কোটি টাকার দুই প্রকল্পেও ধীরগতি
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথের গতি বাড়াতে গত দু'বছরে আরও দুটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নির্মিত দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইনের উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালের নভেম্বরে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের বাইরে যাত্রীসেবা সম্প্রসারণ হলেও পুরোনো রেললাইন ও জরাজীর্ণ সেতুর কারণে এখনো ধীরগতিতেই চলছে ট্রেন।
গত দুই বছরে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার সমন্বিত ব্যয়ে গৃহীত দুইটি ফলো-আপ বা নতুন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে—চট্টগ্রামের পাহারতলী থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৪৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েল গেজে উন্নীতকরণ এবং নতুন কালুরঘাট 'রেল–কাম–রোড' সেতু নির্মাণ।
তবে ঋণচুক্তি সম্পাদনে ধীরগতি এবং চুক্তির শর্তপূরণে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রকল্প দুটি প্রায় স্থবির অবস্থায় রয়েছে। মাঠপর্যায়ে এখনো কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে।
উন্নয়ন কাজ কেন প্রয়োজন
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে ট্রেনকে চট্টগ্রাম স্টেশনে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে এরপর ষোলশহর হয়ে দোহাজারী যেতে হয়। এতে বিরতিহীন ট্রেনসহ সব ট্রেনে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় অপচয় হয়। আর শতবর্ষী, জরাজীর্ণ কালুরঘাট রেলসেতুতে ট্রেনকে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেগে চলতে হয়—দুর্ঘটনাও ঘটে নিয়মিত।
পাহারতলী থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৪৪ কিলোমিটার রেললাইন ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত হলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ট্রেনগুলো পাহারতলী রেলওয়ে স্টেশন থেকে বাইপাস হয়ে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার রুটে যেতে পারবে। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামমুখী অন্যান্য রুটের ট্রেনও কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "টেকসই উন্নয়নের প্রধান শর্ত হলো বিদ্যমান সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার। কিন্তু অবকাঠামো থাকলেও পর্যাপ্ত রোলিং স্টক নেই। এরপর ডুয়েল গেজ লেন ও কালুরঘাট সেতু—দুটিই বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কক্সবাজার রেলপথকে গতিশীল করতে এ প্রকল্পগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, প্রকল্পের ধীরগতির কারণে মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ে, ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়। এই দু'টি প্রকল্পেও সেই শঙ্কা রয়েছে।"
এডিবির ঋণের অপেক্ষায় ডুয়েল গেজ প্রকল্প
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে একনেকে প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত। ১০ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকার এ প্রকল্পে সরকারি অর্থায়ন ৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ৭ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। তবে একনেক অনুমোদনের পরও এখনো এডিবির ঋণের অর্থ পাওয়া যায়নি। ফলে প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি ১০ শতাংশেরও কম।
প্রকল্পটির আওতায় চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে বোয়ালখালীর গোমদন্ডী পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার রেললাইনকে ডুয়েল গেজে ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করা হবে। গোমদন্ডী থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল ট্র্যাক করা হবে। অর্থাৎ পাহাড়তলী থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৩২ কিলোমিটার মেইনলাইন রেলপথ ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত হবে।
এছাড়া পাহাড়তলী–ঝাউতলা বাইপাস রেললাইনকে ৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক করা হবে, লুপলাইনসহ অন্যান্য লাইন মিলে আরও ১০ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার রেলপথ যুক্ত হবে। মোট ৪৪ কিলোমিটার রুটে সমন্বিতভাবে ৬২ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার ট্র্যাক ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত করা হবে।
পাহাড়তলী, ষোলশহর, পটিয়া, কাঞ্চননগর এবং দোহাজারী—এই পাঁচটি স্টেশনে আধুনিক কম্পিউটার–ভিত্তিক ইন্টারলকিং (সিবিআই) সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু করা হবে। পাহাড়তলী, ষোলশহর ও ঝাউতলা—এই তিন স্টেশন ভবন পুনর্নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি ১৪টি স্টেশন ভবনের সংস্কারকাজও থাকবে।
প্রকল্পে ২০টি মেজর এবং ৬৮টি মাইনর ব্রিজ পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি তিনটি রেল ওভারপাস নির্মিত হবে। একই প্রকল্পের অধীনে ৩০টি মিটারগেজ ডিজেল–ইলেকট্রিক (ডিই) লোকোমোটিভ সংগ্রহের পরিকল্পনাও রয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. তানভিরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এডিবির সঙ্গে এখনো ঋণ চুক্তি হয়নি। প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, ২৪ নভেম্বর জমা দেওয়ার শেষ দিন। দরপত্র মূল্যায়ন শেষে প্রতিবেদন দাখিল হলে ঋণচুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রকল্পে ধীরগতি হলে ব্যয় বাড়ে—এটা স্বাভাবিক।"
পরামর্শক নিয়োগে ধীরগতি
জরাজীর্ণ কালুরঘাট রেলসেতুতে ট্রেন ধীরে চলে। একমুখী এই সেতুতে একদিকে যান চলাচল শুরু হলে অন্যদিকে বন্ধ রাখতে হয়। এ পরিস্থিতিতে গত বছরের ৭ অক্টোবর একনেক সভায় কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন রেল–কাম–রোড সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
চলতি বছরের ১৪ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বহুল প্রতীক্ষিত সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে এখন পর্যন্ত সেতুর ডিজাইন–ড্রইং চূড়ান্ত করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারেনি রেলওয়ে। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এই পুরোনো সেতুতে নিয়মিত দুর্ঘটনাও ঘটছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, মোট ১১,৫৬০.৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ৪,৪৩৫.৬২ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার, আর বাকি ৭,১২৫.১৫ কোটি টাকা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটিজ (ইডিপিএফ), কোরিয়া থেকে আসবে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০৩০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নির্বিঘ্ন রেলযোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং ট্রান্স–এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি করা। বর্তমানে পুরোনো কালুরঘাট সেতু দিয়ে ট্রেন ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলতে পারে না। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে ব্যবসা–বাণিজ্য বাড়বে, আর এ রুটের কৌশলগত গুরুত্বও আরও বৃদ্ধি পাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, মূল কাজের মধ্যে রয়েছে ৭০০ মিটার রেল–কাম–রোড ব্রিজ নির্মাণ, ৬.২০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ২.৪০ কিলোমিটার সড়ক ভায়াডাক্ট, ৪.৫৪ কিলোমিটার বাঁধ, ১১.৪৪ কিলোমিটার রেললাইন এবং বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কাজ। এক্সট্রা–ডোজ টাইপ সেতুটির একপাশে থাকবে দুটি ডুয়েল গেজ রেললাইন, অন্যপাশে থাকবে স্ট্যান্ডার্ড মানের দুই লেনের (প্রতিটি লেন ১৮ ফুট) সড়ক। উভয় পাশে সার্ভিস লেন ও পাঁচ ফুট প্রস্থের পথচারী পারাপারের ব্যবস্থাও থাকবে। নদীর মাঝসহ মোট সাতটি স্প্যান থাকবে সেতুটিতে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আবুল কালাম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়ন থাকায় ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রতিটি ধাপেই তাদের অনুমোদন প্রয়োজন। পরামর্শক নিয়োগের জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের শর্টলিস্ট পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন মিললেই পরামর্শক নিয়োগ হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের এপ্রিল–মে মাসে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।"
