শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠবেন যেভাবে
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) আচমকা এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে আঘাত হানে ৫.৭ মাত্রার এ ভূমিকম্প। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যায়, দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে চরম ভীতি ও আতঙ্ক।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ভূমিকম্পটির উপকেন্দ্র ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদীতে। প্রায় ২৬ সেকেন্ড স্থায়ী এ কম্পনটি ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুভূত হওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। কম্পনের সময় ভবনগুলো দুলতে থাকে এবং কোথাও কোথাও জানালার কাচ ভেঙ্গে পড়েছে। এ সময় আতঙ্ক আর নিরাপত্তার জন্য বাসিন্দারা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। কয়েক সেকেন্ডের সেই ভীতি এখনও অনেকের মন থেকে কাটেনি।
আতঙ্কের নানা চিত্র
ভূমিকম্পের সময়কার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানান মিরপুরের বাসিন্দা জারিন তাসনিম। তিনি বলেন, 'আমার মনে হচ্ছিল আমাদের ভবনটি ধসে পড়বে। আতঙ্কিত প্রতিবেশীরা কেউ কেউ রাতের পোশাকেই রাস্তায় নেমে আসেন, সবার চোখে-মুখে ছিল ভয়।'
মোহাম্মদপুরের এক বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, বহুতল ভবনে বসবাস এখন তার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি তার বৃদ্ধ বাবা-মা ও সন্তানদের সাথে সেখানে বসবাস করেন।
তিনি বলেন, 'চাইলেই দ্রুত ওঠানামা করতে পারি না ওপরের বাসা থেকে। ভয়ের কারণে আমি এখন নিচতলার কোনো ফ্ল্যাটে ওঠার কথা ভাবছি।'
গাজীপুরের স্কুলশিক্ষিকা ফারজানা রহমান ভূমিকম্পের মুহূর্তটিকে দুঃস্বপ্ন হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, 'মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে সব ভেঙে পড়বে। আমাদের বাসা দুলছিল, আমার সন্তান ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। এখন আর ফ্ল্যাটবাড়ি নিরাপদ মনে হয় না। এর চেয়ে টিন বা মাটির ঘরই ভালো।'
আফটরশক ও আতঙ্ক
ভূমিকম্প পরবর্তী ছোট ছোট কম্পন বা 'আফটারশক' নিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক রয়ে গিয়েছে। ঢাকার এক বেসরকারি চাকরিজীবী নারী জানান, আফটরশকের আশঙ্কায় তার পরিবার এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
তিনি বলেন, 'পরিবারের সবাই সারাক্ষণ খবরের আপডেট নিচ্ছে। ঢাকার বাইরের আত্মীয়স্বজনরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। কেউ কেউ জরুরি পরিস্থিতির জন্য হাতের কাছে বাঁশি প্রস্তুত রেখেছেন।'
পরিবারের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরাও চরম ভীতির মধ্যে পড়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) তারামন বিবি হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আনিকা রহমান অর্পা জানান, ভূমিকম্পের সময় প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে তার ঘুম ভাঙে। তাকিয়ে দেখেন সিলিং ফ্যান দুলছে। মুহূর্তের মধ্যে ভূমিকম্প নিয়ে তার পুরনো ট্রমা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ছোটবেলার একটি ভূমিকম্পের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'কম্পন থামছিল না দেখে ভেবেছিলাম বাবা-মাকে না দেখেই হয়তো মরে যাব। এরপর থেকে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। ভয় হয়, হয়তো ঘুম থেকে ওঠার আগেই ভবনটি ধসে পড়বে।'
অন্যদিকে, সম্প্রতি ঢাকা থেকে অন্য জেলায় বদলি হওয়া এক বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, ভূমিকম্পের পর তিনি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছেন।
বহুতল ভবনে বসবাসের ঝুঁকি
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের জন্য ওপরের তলা থেকে দ্রুত নিচে নেমে আসাটা বড় চ্যালেঞ্জ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শ্রাবণী জামান জ্যোতি বলেন, 'মনে হচ্ছে আমরা যেন এক মৃত্যুকূপের মধ্যে বসবাস করছি। ভূমিকম্পের সময় ওপরের তলায় থাকা মেয়েরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গত ছয় মাসে বেশ কয়েকবার ছোট ছোট কম্পন আমাদের আরও বেশি ভীত করে তুলেছে।'
তিনি জানান, নিরাপদে বের হওয়াটা অত্যন্ত কঠিন, কারণ এ সময় লিফট ব্যবহার করা যায় না এবং জরুরি সিঁড়িগুলো তার রুম থেকে অনেক দূরে।
সেই ভয়াবহ মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে শ্রাবণী বলেন, 'গতকাল দেখলাম আমাদের হলটি একটি ঝুলন্ত বলের মতো দুলছে। ফুলের টব পড়ে গেল এবং ওয়াশরুমের টাইলসে ফাটল ধরল। আমরা এখনো আতঙ্কের মধ্যে আছি, সারাক্ষণ ভাবছি- আবার এমন হলে কীভাবে পালাব।'
মানসিক ট্রমা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পর অবকাঠামোগত উন্নতির বিষয়টি যেমন জরুরি, তেমনি মানসিক আঘাত বা ট্রমা প্রশমন করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শাহানুর হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মানুষ প্রায়ই ট্রমা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা করে।'
তিনি বলেন, 'যেকোনো ঘটনা যত বেশি আলোচনা বা স্মরণ করা হয়, মানুষের স্মৃতিতে তা তত বেশি স্থায়ী হয়ে যায়। তাই এ অভিজ্ঞতাটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হবে।'
ড. মো. শাহানুর হোসেন আরও উল্লেখ করেন, 'অবকাঠামোগত ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।'
ভয় কাটাতে তিনি কিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, শিশুদের ভয় দূর করতে তাদের বাইরে খেলাধুলায় উৎসাহিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব সম্পর্কেও সতর্ক করে দেন। সেখানে ছড়িয়ে পড়া এ সংশ্লিষ্ট ভিডিও বা কনটেন্ট মানুষের মধ্যে 'সেকেন্ডারি ট্রমা' তৈরি করতে পারে। তাই ভয় বা অনিশ্চয়তা বাড়ায়- এমন কনটেন্ট প্রচার নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
অন্যদিকে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভূমিকম্পের মত দুর্যোগের পর মানসিক ধাক্কা খাওয়া যেকোনো মানুষের জন্য স্বাভাবিক। একে দুর্বলতা হিসেবে দেখা উচিত নয়।'
তিনি বলেন, 'প্রাকৃতিক বা মানুষের তৈরি করা যেকোনো আকস্মিক দুর্যোগ মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করে, যা থেকে অনেক সময় প্যানিক তৈরি হয়।'
তিনি উল্লেখ করেন, 'বাংলাদেশের মানুষ বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যতটা পরিচিত, ভূমিকম্পের সঙ্গে ততটা পরিচিত নয়। তাই বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আমরা মানিয়ে নিতে শিখেছি, কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে তা পারিনি। এ অপরিচিত বিষয়টি আমাদের মনের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'যারা 'প্যানিক অ্যাটাকে ভুগছেন, তাদের জন্য কাউন্সিলিং বা চিকিৎসাসেবা সহায়ক হতে পারে। তবে জনসচেতনতা বাড়ানোও সমানভাবে জরুরি, যাতে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ শান্ত থাকতে পারে।'
তার মতে, শুক্রবারের ভূমিকম্পে কম্পনজনিত ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে আতঙ্কের কারণে মানুষ আহত হয়েছে। মূলত সিঁড়ি দিয়ে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতন না থাকার ফলে এমন দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক।
তিনি বলেন 'তথ্যের ঘাটতি আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে। দুর্যোগের সময় বৈজ্ঞানিক উপায়ে সাড়া দেওয়ার পরিবর্তে মানুষ মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই আরও সচেতন হতে হবে এবং আকস্মিক দুর্যোগে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়, তা শিখতে হবে।'
তিনি পরামর্শ দেন, 'যারা আতঙ্কে ভুগছেন তাদের স্বাভাবিক রুটিন মেনে চলতে হবে। দৈনন্দিন কাজ ও বিনোদনমূলক অভ্যাসগুলো চালিয়ে যেতে হবে। যদি লক্ষণগুলো তীব্র হয়, তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।'
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা প্রায়ই ট্রমা, ভয় এবং ঘটনা অস্বীকার করার মত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করা, আবেগ প্রকাশ করা এবং সামাজিক সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন। এতে 'পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার' (পিটিএসডি), বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের মতো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
নতুন স্বাভাবিকতা
শুক্রবারের ভূমিকম্পে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি সীমিত হলেও মানুষের মনে গভীর মানসিক ক্ষত তৈরি হয়েছে। অনেকের কাছে পায়ের নিচের মাটি আর আগের মতো স্থিতিশীল মনে হচ্ছে না। রাজধানীজুড়ে হাজারো মানুষকে বড় কোনো ভূমিকম্পের ভীতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধকল কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় শুধু ভবন পুনর্নির্মাণ করলেই হবে না, বরং একটি 'নতুন স্বাভাবিক' অবস্থা ফিরিয়ে আনতে নিরাপত্তার অনুভূতি ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করাও জরুরি।আচ্ছা
