চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণক্ষমতার তিন গুণ বন্দি, ছয় বছর ধরে থমকে আছে সম্প্রসারণ কাজ
অতিরিক্ত বন্দি নিয়ে ধুঁকছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। এই কারাগারে বন্দির সংখ্যা এখন অফিশিয়াল ধারণক্ষমতার প্রায় তিনগুণ।
২ হাজার ২৪৯ জন বন্দির জন্য তৈরি এই কারাগারে প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষ থাকছেন। জায়গার অভাবে কারা প্রশাসন ও বন্দি—উভয়ই চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
অতিরিক্ত বন্দির চাপের কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে। ২০২১ সালের ৬ মার্চ এই কারাগার থেকে হত্যা মামলার আসামি ফরহাদ হোসেন দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। পরে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্ত কমিটি তখন অতিরিক্ত বন্দির চাপ ও জনবল ঘাটতির বিষয়টি তুলে ধরে জেলা ও মহানগর থানার আসামিদের আলাদা রাখার সুপারিশ করেছিল, যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
বন্দির চাপ কমাতে নতুন কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত জটিলতায় গত ছয় বছরে কোনো অগ্রগতি হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষের বারবার তাগাদা সত্ত্বেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।
২ নভেম্বর এক সভায় চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলার জন্য পৃথক কারাগার নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) মো. ছগির মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার এখন কার্যত একটি আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এত বিশাল সমস্যার সমাধান কোনো ব্যক্তির একার পক্ষে সম্ভব নয়। বহু আগেই উত্তর ও দক্ষিণ জেলার জন্য আলাদা কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।'
কারা পরিদর্শক আতাউল্লাহ সম্রাট বলেন, 'দুনিয়ার কোথাও আমাদের দেশের মতো বেহাল দশার কারাগার নেই। একজনের তোশক আরেকজন ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে রোগ-বালাই ছড়ায়। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিশুদ্ধ পানি, কয়েদিদের তোশক পরিষ্কারের বিষয়ে আমরা জোর দিয়েছি। আমরা চাই এই কারাগার আরও আপডেট হোক, যাতে কয়েদিদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতহয়, তারা যথাযথভাবে এখানে থাকতে পারেন। নতুন কারাগার করা গেলে সেক্ষেত্রে কয়েদিরা আরও ভালো সুযোগ-সুবিধা পাবেন।'
জনবল সংকট
অতিরিক্ত বন্দির চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তীব্র জনবল সংকট। এ কারাগারে বর্তমানে কর্মরত আছেন একজন সিনিয়র জেল সুপার, একজন জেলার, তিনজন ডেপুটি জেলার, ১৫ জন প্রধান কারারক্ষী, ৩০ জন সহকারী প্রধান কারারক্ষী, ৩৫১ জন কারারক্ষী ও ১১ জন নারী কারারক্ষী।
সিনিয়র জেল সুপার বলেন, 'কর্মী সংকট ভয়াবহ। ডেপুটি জেলার পদে আরও তিনজন এবং অন্তত ১০০ জন অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যাও বাড়ছে। কয়েক বছর আগেও যেখানে ৫০-৬০ জন ছিল, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৬ জনে।'
বর্তমানে কারাগারে শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দি এখন মাত্র দুইজন—চিন্ময় দাশ ও ব্যবসায়ী গ্রুপ কেডিএসের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের ছেলে ইয়াছিন রহমান টিটু। তারা আলাদা খাট ও ডাইনিং সুবিধা পান।'
থমকে আছে নতুন কারাগার প্রকল্প
বন্দিদের চাপ কমাতে নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও জমি অধিগ্রহণে ছয় বছরের দীর্ঘসূত্রতায় তা আটকে আছে।
সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় ৭৫ একর জায়গা নির্বাচন করা হয়েছিল নতুন কারাগার নির্মাণের জন্য। কিন্তু জায়গাটি দখলদারদের হাতে থাকায় অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি। ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবরে জমি চেয়ে চিঠি দেওয়া হলেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।
কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, জঙ্গল সলিমপুরের সরকারি জমিতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ অবৈধভাবে বসবাস করছে। গত কয়েক দশক ধরে পাহাড় কাটা এবং অপরিকল্পিত বসতি স্থাপনের মাধ্যমে এই এলাকাটি গড়ে উঠেছে।
প্রভাবশালী মহলের সংঘবদ্ধ বাধার কারণে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবিত জমি অধিগ্রহণে এই অস্থিতিশীলতাই প্রধান বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম নগর বস্তিবাসী সংগ্রাম পরিষদের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, অন্যত্র পুনর্বাসন ছাড়া সেখানকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা যাবে না।
এলাকাটি খালি করা সম্ভব হলেও ঘনবসতি, অবৈধ স্থাপনা, পরিবেশগত ছাড়পত্র ও দীর্ঘ নির্মাণ প্রক্রিয়ার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে আট থেকে দশ বছর সময় লেগে যেতে পারে।
কারা কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, অবিলম্বে বিকল্প জায়গা না পাওয়া গেলে বর্তমান অতিরিক্ত বন্দির চাপ বড় ধরনের প্রশাসনিক সংকটের জন্ম দিতে পারে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বন্দি সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম কারাগার। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৯৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর একে কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৩৪ সালে এই কারাগারেই বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তার সহযোগী তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জনরোষ এড়াতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের মরদেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়।
