বিটিআরসির ‘প্রশাসনিক গাফিলতিতে’ ১৭ বছর ধরে আটকে আছে গোল্ডেন স্পেকট্রাম
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ১৭ বছর পুরোনো "প্রশাসনিক গাফিলতি" এখন জটিল আইনি অচলাবস্থায় রূপ নিয়েছে। ফলে দেশের সবচেয়ে মূল্যবান মোবাইল স্পেকট্রামের বরাদ্দ অবরুদ্ধ হয়ে আছে। এতে করে রাষ্ট্র হারিয়েছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব, বিলম্বিত হয়েছে ৪জি–৫জি'র সম্প্রসারণ।
এই বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে বহুল কাঙ্ক্ষিত ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড —উচ্চতর কাভারেজের জন্য যা বৈশ্বিকভাবে 'গোল্ডেন স্পেকট্রাম' নামে পরিচিত। সে ব্যান্ডই ২০০৭ সালে একটি ছোট ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) 'অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড' (এওএনবি)–কে বরাদ্দ করে বিটিআরসি।
প্রায় ৯ কোটি টাকার একটি সাধারণ লাইসেন্সের আওতায় সম্পূর্ণ বিনা ফিতে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে সময়ের অনেক কর্মকর্তা ভবিষ্যতে মোবাইল ব্রডব্র্যান্ডের জন্য এই ফ্রিকোয়েন্সির কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখতেন না।
ব্যয়বহুল ভুল
পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে যখন বিটিআরসি পরবর্তীতে এই ১২ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম ফেরত চাইতে যায়—যা এখন আধুনিক মোবাইল সেবার জন্য নির্ধারিত ৪৫ মেগাহার্টজ ব্লকের অংশ। যা আদালতে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে রূপ নেয়। বরাদ্দ বাতিলের পর সৃষ্ট ক্ষতির অভিযোগ তুলে, আইএসপি প্রতিষ্ঠানটি এখন ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পর্যন্ত দাবি করছে।
বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, এই স্পেকট্রাম অবরুদ্ধ থাকার কারণে শুধু সম্ভাব্য নিলাম রাজস্ব থেকেই রাষ্ট্র বঞ্চিত হয়েছে প্রায় ১২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। একইসঙ্গে ফ্রিকোয়েন্সি অবরুদ্ধ থাকায় ব্যাহত হয়েছে সেবা সম্প্রসারণ।
এই বিরোধের জেরে ব্যাহত হয়েছে সারাদেশে শক্তিশালী ৪জি ও ৫জি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার অগ্রগতি। ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড বিস্তৃত কাভারেজ লেয়ার তৈরির জন্য অপরিহার্য—বিশেষত গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায়, যেখানে বিদ্যমান নেটওয়ার্ক দুর্বল। টেলিকম অপারেটররা জানায়, আরেকটি জটিলতা হলো—আংশিক স্পেকট্রাম বরাদ্দে কোনো কেউই নিলামে অংশ নিতে রাজি নয়। এজন্য বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পুরো ৪৫ মেগাহার্টজ ব্লকই এখন ব্যবহার অযোগ্য অবস্থায় পড়ে আছে।
আইনি জট
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি–বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অমূল্য এ ফ্রিকোয়েন্সিটি ২০০৭ সালে ভুলবশত আইএসপি প্রতিষ্ঠান এওএনবি–কে দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৯ কোটি টাকার লাইসেন্সের আওতায়। প্রতিষ্ঠানটি এই বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্যতাও রাখত না।"
আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সুপারিশের পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বিটিআরসি স্পেকট্রাম বরাদ্দটি বাতিল করে। আইটিইউ ২০১০ সাল থেকে এই ব্যান্ডকে আন্তর্জাতিক মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন (আইএমটি)–এর জন্য বিবেচনা শুরু করে।
কিন্তু ২০১৫ সালের মার্চে এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে এওএনবি উচ্চ আদালতে রিট করে, এবং ২০২৩ সালে আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন—যেখানে বিটিআরসির বরাদ্দ বাতিলকে অবৈধ বলা হয়।
ফয়েজ তৈয়্যব জানান, বিটিআরসি তার "আইনজীবীদের দুর্বল যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জেরে" উচ্চ আদালতে হেরে যায়। ৩১ আগস্ট ২০২৫–এর একটি লিভ টু আপিল আদেশের পর বর্তমানে বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
আইএসপি কোম্পানিটির বক্তব্য
এওএনবি–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজ শাহিদ তার প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সমর্থন করে দাবি করেন, বিটিআরসি হঠাৎ করে বরাদ্দ বাতিলের আদেশ দেওয়ার আগে তারা উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছিলেন।
টিবিএস-কে তিনি বলেন, "যখন বিটিআরসি ফ্রিকোয়েন্সি দিয়েছিল, তখন ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড নিয়ে আইটিইউ–এর কোনো নির্দেশনা ছিল না… তবে পরে যে নির্দেশনা এসেছে, সেখানে বলা আছে—আগে বরাদ্দ থাকলে তা অব্যাহত রাখতে হবে বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু বিটিআরসি দুটোর কোনোটাই করেনি। তাই আমরা আদালতে যাই।"
২০২০ সালে পাঠানো একটি চিঠিতে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় ৮০০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর সেই দাবি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটিতে। তবে মামলাটি বিচারাধীন হওয়ায় ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি রিয়াজ শাহিদ।
আইটিইউ ২০১০ সালে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডকে আইএমটি খাতে চিহ্নিত করা শুরু করে, এবং ২০১২ সালে এর সুপারিশ করে। আর ২০১৫ সালে এসে মোবাইল ব্রডব্যান্ডের সমর্থনে ৬৯৪–৭৯০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে সমন্বিত বৈশ্বিক কাঠামো চূড়ান্ত করে।
বিটিআরসির বরাদ্দপত্রে দেখা যায়, ব্যান্ডটি এওএনবি–কে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল। তবে সেখানে একটি শর্ত ছিল—ব্যান্ডটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে বরাদ্দ বাতিল করা যাবে।
গাফিলতি থেকে আদালতে
২০০৭ সালে একটি সাধারণ আইএসপি লাইসেন্সের আওতায় এবং কোনো নিলাম ফি ছাড়াই বিটিআরসি এওএনবি–কে ব্যান্ডটির দুই পাশে মোট ১২ মেগাহার্টজ বরাদ্দ দেয়। বিটিআরসির ভাষ্যমতে, সেই সময় তারা ব্যান্ডটির ভবিষ্যৎ গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা করতে পারেনি। তবে ২০১০ সালে এসে বুঝতে পারে বরাদ্দটি ছিল "ভুল সিদ্ধান্ত" এবং তখনই স্পেকট্রামটি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়।
২০১০ বিটিআরসি প্রতিষ্ঠানটিকে অন্য একটি স্পেকট্রাম শ্রেণিতে স্থানান্তর করতে চাইলে এওএনবি তা প্রত্যাখ্যান করে। এর চার বছর পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বরাদ্দ বাতিল করা হয়। ২০১৫ সালের মার্চে এওএনবি হাইকোর্টে রিট করে।
২০২৩ সালে আদালত কোম্পানিটির পক্ষে রায় দেন, এবং বিটিআরসির বরাদ্দ বাতিলকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর বিটিআরসি আপিল বিভাগে যায়। সেখানে চূড়ান্ত রায় এখনো আসেনি; আর আইনি এই বিরোধের জেরে স্পেকট্রাম বরাদ্দ অবরুদ্ধই রয়েছে।
২০২০ সালের অক্টোবরে বিটিআরসি'কে পাঠানো চিঠিতে এওএনবি'র এমডি রিয়াজ শাহিদ দাবি করেন, বরাদ্দ বাতিলের কারণে কোম্পানিটি ও এর বিদেশি অংশীদাররা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে। এজন্য ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। উচ্চ আদালতের রায়ের পর সেই দাবি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটিতে।
বিশ্বে এক 'ব্যতিক্রম'
২০১৫ সালে বিটিআরসির একটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, "এওএনবি কখনো অর্থবহ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেনি কিংবা ব্যান্ডটি ব্যবহার সক্ষম অবকাঠামো স্থাপন করেনি। প্রায় দুই দশক আগে আমদানি করা যন্ত্রপাতিগুলোও এখন অচল।"
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতিষ্ঠানটির এমডি আবারও বিচারাধীন অবস্থার কথা বলে মন্তব্য এড়িয়ে যান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের কোনো দেশ সাধারণ একটি আইএসপিকে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড ব্যবহারের সুযোগ দেয় না। আইটিইউ এই ব্যান্ডকে এলটিই, এনবি-আইওটি ও ৫জি সিস্টেমের জন্য নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ এখন এক ব্যতিক্রম—নিজস্ব ভুলে সৃষ্ট অচলাবস্থার মধ্যে আটকে আছে।
মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি টেলিকম প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক টিবিএস'কে বলেন, "৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড টেলিকম অপারেটরদের জন্য নির্ধারিত। একটি আইএসপি'তে এই ব্যান্ডের কোনো ব্যবহার নেই।"
চলতি বছরের ৩১ আগস্ট, লিভ টু আপিল আদেশের পর বিষয়টি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রক্ষায় এখন সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
কেন ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড এত গুরুত্বপূর্ণ
বিশ্বব্যাপী ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডকে ধরা হয় মোবাইল নেটওয়ার্কের 'ব্যাকবোন লেয়ার' হিসেবে। এটি অনেক দূর যেতে পারে, দেয়াল ভেদ করে ঘরের ভেতরে সিগন্যাল পৌঁছাতে পারে। ফলে মাঝারি-ব্যান্ডের তুলনায়, গ্রামাঞ্চল ও মহাসড়ক সংলগ্ন অঞ্চলে খুব কম সংখ্যক টাওয়ার স্থাপন করেই বিস্তৃত কাভারেজ দেওয়া সম্ভব হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক নির্ভর করছে ১৮০০, ২১০০ ও ২৩০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ওপর। এসব ব্যান্ডের সক্ষমতা থাকলেও কাভারেজের ঘাটতি আছে। নিম্ন ব্যান্ড না থাকায় অপারেটরদের বিনিয়োগের চাপ বাড়ছে এবং গ্রামীণ এলাকায় সেবার বৈষম্য দেখা দিচ্ছে।
৮০০ ও ৯০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড এখনও ২জি–তে আটকে আছে, যা এখনো খাতটির মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক জোগান দেয়।
শুধু মাঝারি-ব্যান্ড দিয়ে কাভারেজের ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। ৭০০ মেগাহার্টজের সমান কাভারেজ পেতে হলে অপারেটরদের প্রায় দ্বিগুণ টাওয়ার স্থাপন করতে হবে—যা বিনিয়োগকে নগরকেন্দ্রিক করে তুলবে এবং গ্রামাঞ্চলে সেবার সম্প্রসারণ আরও পিছিয়ে দেবে।
