ফের ব্যর্থ অপারেটর নিয়োগের চেষ্টা; অলস পড়ে আছে ৮,৩০০ কোটি টাকার তেল খালাস স্থাপনা
মহেশখালীর অদূরে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগশিপ অপরিশোধিত তেল আমদানির স্থাপনা—৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পটি—আরও বেশ কিছুদিন অব্যবহৃতই পড়ে থাকতে পারে। কারণ এটি পরিচালনার জন্য অপারেটর নিয়োগের সর্বশেষ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
এসপিএম নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে (সিপিপিইসি) প্রথমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় স্থাপনাটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই পরিকল্পনা বাতিল করে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে।
এক ডজনেরও বেশি কোম্পানি দরপত্র কিনলেও জমা দেয় মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান: বয়া প্রস্তুতকারক ব্লুওয়াটারের সঙ্গে সিপিপিইসির যৌথ উদ্যোগ এবং ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পারতামিনা। এর মধ্যে সিপিপিইসি-ব্লুওয়াটারকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং পারতামিনার প্রস্তাবিত দর বাজেটের চেয়ে বেশি ছিল।
ফলে প্রক্রিয়াটি ফের থমকে গেছে। জ্বালানি তেল খালাসের পদ্ধতি আমূল বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি এই ব্যয়বহুল অবকাঠামোটি কমিশনিংয়ের দেড় বছর পরও অলস পড়ে আছে।
সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং—এসপিএম হলো একটি ভাসমান জেটি, যার সঙ্গে ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ অফশোর ও অনশোর পাইপলাইন যুক্ত। এর মাধ্যমে তেলবাহী জাহাজ থেকে সরাসরি ডিপোতে তরল জ্বালানি পাঠানো যাবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এর কমিশনিং হয়। এসপিএম কার্যকর থাকলে তেল খালাসের সময় প্রায় দুই সপ্তাহ থেকে কমে মাত্র দুই দিনে নেমে আসত। এতে বছরে সাশ্রয় হতো প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান দুই মাস আগে সর্বশেষ টেন্ডার বাতিলের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'যোগ্য দরদাতার প্রস্তাব আমাদের বাজেটের চেয়ে বেশি ছিল। এখন সরকার চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা দুটি জিটুজি প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে।'
যদি এগুলোর কোনোটিই অনুমোদিত না হয়, তবে পুনরায় দরপত্র ডাকার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ—প্রক্রিয়াগত কারণে যা ফেব্রুয়ারির আগে শুরু করা সম্ভব নয়।
জিটুজি পর্যালোচনা ও বর্তমান প্রক্রিয়া সফল হলেও এসপিএম পুরোদমে চালু হতে আরও অন্তত ছয় মাস সময় লাগতে পারে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এখন সাগরের বুকে পড়ে থেকে পুরো ব্যবস্থাটি নষ্ট হচ্ছে।
বিয়ারিং, সুইভেল, সাব-সি হোস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পড়ে আছে। প্রকৌশলীরা বলছেন, উত্তাল সমুদ্রের কারণে যন্ত্রপাতিতে দ্রুত মরচে ধরছে। যত দেরি হবে, সিস্টেমটিকে সচল অবস্থায় ফিরিয়ে আনার খরচ তত বাড়বে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম সতর্ক করে বলেন, অলস পড়ে থাকার কারণে যন্ত্রপাতির কার্যক্ষমতা নষ্ট হবে। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'এগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। এগুলো সচল করতে সরকারকে ফের টাকা খরচ করতে হবে।'
তবে বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান দাবি করেন, নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটি এখনো দায়িত্বে আছে এবং যন্ত্রপাতি সচল রাখতে রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ অপারেটর নিয়োগে বিলম্বের জন্য সরকারের অদক্ষতা ও অনীহাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, 'সরকারের অদক্ষতার কারণেই ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে অলস পড়ে আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বন্দর টার্মিনাল ইজারা দিতে সরকার তাড়াহুড়ো করছে, কিন্তু এসপিএম সচল করার ক্ষেত্রে তাদের চরম অনীহা দেখা যাচ্ছে।'
দরপত্র প্রক্রিয়ায় কেন অগ্রগতি হলো না?
প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্টরা দরপত্রের শর্তাবলিতে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন। তাদের মতে, দরপত্র খোলার অনেক আগেই শর্তের কারণে প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে গিয়েছিল। তারা বলছেন, সমস্যাটি কারিগরি নয়, বরং প্রশাসনিক।
অফশোর ও অনশোর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন, তাই এগুলো আলাদা চুক্তির মাধ্যমে হতে হয়। কিন্তু টেন্ডারে এসপিএম অপারেশন ও ট্যাংক-ফার্ম ব্যবস্থাপনা—দুটি কাজকে একীভূত করা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট দক্ষতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো নিরুৎসাহিত হয়ে থাকতে পারে।
এ ধরনের কাজের জন্য বিদেশি এসপিএম পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকাটা আদর্শ মানদণ্ড হলেও নথিপত্রে তা চাওয়া হয়নি।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীরা বলছেন, এত বড় পরিসরের অফশোর সিস্টেম চালানোর কারিগরি চাহিদার সঙ্গে বাজেটের মিল নেই। দরপত্রের শর্তে যখন অসামঞ্জস্যপূর্ণ দায়িত্ব মিশিয়ে দেওয়া হয় এবং মুনাফার সুযোগ কমিয়ে দেওয়া হয়, তখন নির্ভরযোগ্য অপারেটররা সরে দাঁড়ায় এবং প্রক্রিয়াটি আর প্রতিযোগিতামূলক থাকে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বাসযোগ্য ও বৈশ্বিক মানের দরপত্র নিশ্চিত করতে হলে বিদেশি এসপিএম পরিচালনার অভিজ্ঞতাসহ যোগ্যতার মানদণ্ডগুলো পুনর্বহাল করা প্রয়োজন।
