চট্টগ্রাম–ঢাকা জ্বালানি পাইপলাইনের সরবরাহ এখনও বন্ধ, চালু হতে পারে এ মাসেই
উদ্বোধনের এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও হিসাবে গরমিল, সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি ও প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম–ঢাকা পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
ফলে বহুল প্রত্যাশিত এই প্রকল্পের সুফল এখনো মেলেনি। বাধ্য হয়ে আবারও সড়ক ও নৌপথে বেশি খরচে জ্বালানি পরিবহন করা হচ্ছে।
গত ২২ জুন পরীক্ষামূলকভাবে জ্বালানি সরবরাহ চালু করা হয় এবং ১৬ আগস্ট পাইপলাইনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। তবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হিসাবে গরমিল দেখা দিলে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সমস্যাগুলোর বেশিরভাগই এখন সমাধান হয়েছে এবং নভেম্বরের মধ্যেই সরবরাহ পুনরায় শুরু হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "ফ্লোমিটার ও তার সংযোগের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। আগামী সপ্তাহে বৈঠকে বসে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ পুনরায় শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আশা করা হচ্ছে, এ মাসের মধ্যেই সরবরাহ চালু হবে।"
তিনি আরও জানান, সংরক্ষণাগারের ধারণক্ষমতা নির্ধারণে বিএসটিআই ডিপো ট্যাংকগুলোর ক্যালিব্রেশন সম্পন্ন করেছে। তদন্ত কমিটি বিএসটিআই কর্মকর্তাদের তলব করবে, কারণ সমস্যা তাদের তত্ত্বাবধানেই উদ্ভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরেক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনে গরম জ্বালানি প্রবেশ করিয়ে ঢাকায় পৌঁছানোর পথে তা ঠান্ডা হয়ে যায়, এতে পরিমাপে তারতম্য দেখা দেয়। এ কারণে প্রযুক্তিগত সমন্বয় করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে চূড়ান্ত পরীক্ষামূলক সরবরাহ চালানো হবে, এরপর বিপিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "একবার তেল পাইপলাইনে প্রবেশ করলে তা কেবল ঢাকাতে পৌঁছানোর পরই বের হতে পারে; অন্যথায় ভেতরেই থেকে যায়। এছাড়া, আমাদের লিক শনাক্তকরণ প্রযুক্তিও রয়েছে—পাইপলাইনের আশপাশে কেউ খনন শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্কবার্তা চলে আসে। ফলে তেল সরিয়ে নেওয়া বা চুরি করা কার্যত অসম্ভব।"
কেন বন্ধ হয়েছিল কার্যক্রম?
বন্ধের আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে মেঘনা অয়েল ৩২.২ মিলিয়ন লিটার এবং পদ্মা ও যমুনা অয়েল প্রায় ৩০ মিলিয়ন লিটার করে মোট সাতটি চালান পাঠিয়েছিল।
তবে গোধনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে পৌঁছানোর পর মেঘনা ও পদ্মা অয়েলের চালান থেকে অন্তত ৫০ হাজার লিটার তেল কম পাওয়া যায়। যমুনা অয়েলও দুটি পৃথক ক্ষেত্রে ফতুল্লা ডিপোতে মোট ৩ লাখ ৭৫ হাজার লিটার ডিজেল ঘাটতির কথা জানায়। এসব অসঙ্গতি ধরা পড়ার পর পাইপলাইনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জ্বালানির হিসাব, ট্যাংকের সংরক্ষণক্ষমতা ও পরিমাপের নির্ভুলতায় অনিয়ম ধরা পড়েছে। এর ফলে পাইপলাইনের সরবরাহ বন্ধ করে আবারও নদী, রেল ও সড়কপথে জ্বালানি পরিবহন শুরু করতে হয়েছে। এতে ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি অপচয় ও চুরির ঝুঁকিও বেড়েছে।
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ
নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩,৬৯৯ কোটি টাকা। প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের গোধনাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। পাইপলাইনটি ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও মুন্সিগঞ্জ হয়ে ঢাকায় পৌঁছেছে।
প্রকল্পে রয়েছে ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ২৪১.২৮ কিলোমিটারের মূল পাইপলাইন এবং ১০ ইঞ্চি ব্যাসের ৮.২৯ কিলোমিটারের সংযোগ লাইন, যা গোধনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত। মোট ২২টি নদী ও খাল অতিক্রম করেছে এই রুট—যার মধ্যে ১০টি প্রধান নদী রয়েছে। এসব নদীর বেশিরভাগ অংশেই পাইপগুলো নদীর তলদেশের নিচ দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৯টি স্টেশন এবং বরুড়ায় ২১ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি ডিপো। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
তবে এখনো বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটির দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। ত্রুটি শনাক্ত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের আগেই সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে প্রকল্পটি গ্রহণ করিনি, তবে খুব শিগগিরই গ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।"
প্রকল্পের লক্ষ্য
দেশের মোট জ্বালানি ব্যবহারের প্রায় ৪০ শতাংশই হয় ঢাকা বিভাগে। বর্তমানে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নৌপথে নারায়ণগঞ্জে এবং সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় জ্বালানি পরিবহন করা হয়; এই কাজে প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি জাহাজ ব্যবহৃত হয়।
পাইপলাইনটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে বছরে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টন জ্বালানি পরিবহন সম্ভব হবে, এতে প্রতি বছর সাশ্রয় হবে প্রায় ২২৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, বর্তমানে ২.৭–৩ মিলিয়ন টন পরিবহন সক্ষমতা রয়েছে, যা ভবিষ্যতে ৫ মিলিয়ন টনে উন্নীত করা যাবে।
প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য পরিবহন ব্যয় কমানো, তেল চুরি ও অপচয় রোধ করা, এবং নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।
পূর্ণমাত্রায় কার্যক্রম শুরু হলে পাইপলাইনটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বছরে ২.৭ মিলিয়ন টন (প্রায় ৩১৭ কোটি লিটার) ডিজেল সরবরাহ করবে। বর্তমানে দেশে বার্ষিক জ্বালানি চাহিদা প্রায় ৬.৫–৬.৮ মিলিয়ন টন, যার ৬৩ শতাংশই ডিজেল।
