এখনও ৪৭% মেয়ের বিয়ে ১৮-র আগে; ঢাকার ৬৫% শিশুর রক্তে সিসা; শিশুশ্রমে যুক্ত ১২ লাখ: জরিপ
বাংলাদেশে নতুন করে আরও ১২ লক্ষ শিশু শ্রমে যুক্ত হয়েছে, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে প্রায় চারজনের রক্তে পাওয়া গেছে 'উদ্বেগজনক' মাত্রার সিসা এবং অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে অস্ত্রোপচারের [সিজারিয়ান ডেলিভারি] মাধ্যমে শিশু জন্মের হার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের 'মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০২৫'-এর প্রাথমিক ফলাফলে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা ও সুরক্ষা নিয়ে এমন উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
বিবিএসের এই জরিপে প্রথমবারের মতো শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে, যা শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশগত হুমকির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। রোববার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে এই জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর পরিচালিত হয় এই জরিপ।
জরিপের প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, দেশের ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ৩৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা 'উদ্বেগজনক' পর্যায়ে রয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ঢাকায়, যেখানে ৬৫ শতাংশ শিশু সিসা দূষণের শিকার। সিসার এই বিষক্রিয়া শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
শুধু শিশুরাই নয়, প্রায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ গর্ভবতী নারীর রক্তেও উচ্চমাত্রার সিসা পাওয়া গেছে। শিল্পবর্জ্য, অনানুষ্ঠানিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া এবং অনিরাপদ পণ্য থেকে এই দূষণ ছড়াচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
একইসাথে, ২০১৯ সালের তুলনায় দেশে শিশুশ্রমের হার বেড়েছে। বর্তমানে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৯ দশমিক ২ শতাংশ শিশুশ্রমে নিযুক্ত, যা ২০১৯ সালে ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এর ফলে নতুন করে প্রায় ১২ লাখ শিশু শ্রমে যুক্ত হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে এই হার প্রায় ১১ শতাংশ, যা মেয়েদের (৪ শতাংশ) তুলনায় অনেক বেশি।
শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক সূচক
জরিপ অনুযায়ী, দেশে বাল্যবিবাহের হার ২০১৯ সালের ৫১.৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৭ শতাংশে নেমেছে। এখনও দেশের প্রায় অর্ধেক মেয়ের বিয়ে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই অর্থাৎ প্রতি দুটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে।
বাল্যবিবাহের হার কমলেও, কিশোরী বয়সে সন্তান জন্মদানের হার বেড়েছে। ২০১৯ সালে প্রতি এক হাজার কিশোরীর মধ্যে জন্মহার ছিল ৮৩, যা ২০২৫ সালের জরিপে বেড়ে ৯২ হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রতি চারজন গ্রামীণ নারীর একজন এবং প্রতি পাঁচজন শহুরে নারীর একজন ১৮ বছর বয়সের আগেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের ১৮ বছর বয়সের আগে মা হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে সচ্ছল পরিবারের মেয়েদের তুলনায় তিনগুণ বেশি। গ্রামীণ পরিবার, দরিদ্র পরিবার এবং শুধু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করা নারীদের মধ্যেই কিশোরী বয়সে মা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি।
জরিপ অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার ৮৪ শতাংশ এবং নিম্ন মাধ্যমিকে প্রায় ৬০ শতাংশ। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার প্রায় ৫০ শতাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে।
স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়ে ৯২ শতাংশে পৌঁছালেও, ৮০ শতাংশের বেশি পরিবারের খাবার পানিতে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
লাগামহীন সিজারিয়ান ডেলিভারি
জরিপে দেখা গেছে, দেশে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরাঞ্চলে ৫৬ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ানের মাধ্যমে। নারীর সম্পদ ও শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই হারও বাড়ছে।
মাতৃস্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও চিত্রটি পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। গর্ভকালীন সময়ে ৯৩ শতাংশ নারী অন্তত একবার দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পেলেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী অন্তত চারটি সেবা পেয়েছেন মাত্র ৪৩ শতাংশ নারী।
প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় প্রসবের হার বেড়ে ৭১ শতাংশ এবং দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তায় প্রসবের হার ৭৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে জন্মের পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করার হার কমে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।
পুষ্টিহীনতা ও শিশুমৃত্যু পরিস্থিতি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বাকৃতির হার কমে ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে তীব্র অপুষ্টির নির্দেশক কৃশকায় বা 'ওয়েস্টিং'-এর হার ৯.৮ শতাংশ (২০১৯) থেকে বেড়ে ১২.৯ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া, ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ মা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
তবে শিশুমৃত্যুর হারে কিছুটা অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। গত পাঁচ বছরে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩৩ জনে নেমে এসেছে, যা আগে ছিল ৩৯ জন। নবজাতকের মৃত্যুর হারও প্রতি হাজারে ২৬ থেকে কমে ২২ জনে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও নীতিগত পরামর্শ
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মেহীন সুলতান বলেন, 'শিক্ষিত ও তুলনামূলকভাবে সচ্ছল পরিবারের মধ্যে সিজারিয়ান অপারেশনের হার আরও বেশি—যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি দেখায় যে প্রসবকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে মেডিকেলাইজ ও ইনস্টিটিউশনালাইজ করা হচ্ছে। ফলে মা ও নবজাতকের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে এবং পরিবারগুলোর ওপর বিশাল আর্থিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।'
মেডিকেল শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সাবেক সচিব ড. মো. সারওয়ার বারী বলেন, 'যে বিষয়টি আমাকে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করেছে, তা হলো সীসা দূষণ। অর্ধেকেরও বেশি শিশুর রক্তে উচ্চমাত্রার সীসা পাওয়া যাচ্ছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিশেষ করে ব্যবহৃত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি অনানুষ্ঠানিক উপায়ে ভাঙা ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যে দূষণ ছড়াচ্ছে, তা শিশুদের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে।'
ওয়াটারএইড দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. খায়রুল ইসলাম পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের বৈষম্যকে প্রধান নীতিগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, 'আমরা শহর ও সচ্ছল নাগরিকদের জন্য পানি সরবরাহ নিয়ে আলাদা ধরনের ভাবনা করি, আর গ্রামীণ মানুষের জন্য চিন্তা করি একেবারে ভিন্নভাবে। এই শহর–গ্রাম বৈষম্যই মূল নীতি সমস্যা। আপনারা ডেটা থেকেও দেখেছেন—৮৫ শতাংশ পানি সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে নারী ও কিশোরীদের ওপর। অর্থাৎ, এই বৈষম্য শুধু প্রযুক্তিগত নয়; এটি লিঙ্গ-বৈষম্যও তৈরি করছে।'
