বাল্যবিবাহের শিকার বাবা-মায়ের সন্তানেরা কেন জন্ম নিবন্ধন, টিকাদানসহ মৌলিক নাগরিক সেবাবঞ্চিত হবে?

সম্প্রতি একটি খবর আমাকে গভীরভাবে বিস্মিত করেছে—বাল্যবিবাহের শিকার বাবা-মায়ের সন্তানেরা জন্ম নিবন্ধন ও টিকাদানসহ অন্যান্য মৌলিক নাগরিক সেবা পেতে বাধার মুখে পড়ছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নেওয়া নানা উদ্যোগের মধ্যে একটি হলো- বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য ব্যবহৃত বিডিআরআইএস সফটওয়্যারটি বাবা-মায়ের বয়স যাচাইয়ের জন্য প্রোগ্রাম করা। এর ফলে মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে বা বাবার বয়স ২১ বছরের নিচে হলে তাদের সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছে না।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ১৮ বছরের নিচে মা এবং ২১ বছরের নিচে বাবার সন্তানের জন্ম নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে। অর্থাৎ সিস্টেম দ্বারা বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে। তবে টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত না হওয়ার জন্য টাইফয়েড টিকার ক্ষেত্রে অক্টোবর পর্যন্ত সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে।
এক শিশুর অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে আরেক শিশুর অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো এই বিধান নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সরকার কেন বা কীভাবে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, তা বোধগম্য নয়—বিশেষ করে যখন ইউএনএফপিএর স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৫ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জন ১৫–১৯ বছর বয়সী মেয়ের মধ্যে ৭১ জনের এক বা একাধিক সন্তান রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুর জন্ম নিবন্ধন থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
শিশু সুরক্ষার ভিত্তি শুরু হয় জন্ম নিবন্ধন ও জীবনরক্ষাকারী টিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। অথচ শুধু বাবা-মা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন বলে তাদের সন্তানকে জন্ম নিবন্ধনের বাইরে রাখা হচ্ছে—যা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা, ২০১৮–এর পরিপন্থী। আইন অনুযায়ী, জন্ম নিবন্ধন একটি আইনি বাধ্যবাধকতা এবং নাগরিকের অধিকার।
১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বিষয়টি উল্লেখ করে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। পরবর্তীতে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত সিস্টেমে শিথিলতা আনা হয়, যাতে শিশুরা অন্তত টাইফয়েড টিকা নিতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন উদাহরণ পাওয়া যায়নি, যেখানে একটি শিশুর জন্ম নিবন্ধন বাবা-মায়ের বয়সের ওপর নির্ভর করছে।
ধরে নেওয়া যায়, সরকারের উদ্দেশ্য মহৎ—বাল্যবিবাহের পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো সচেতনতামূলক বার্তা বা প্রচার প্রচেষ্টা এখনো চোখে পড়েনি, কিংবা এ সচেতনতা আদতে কোনো সুফল বয়ে আসবে কি না, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন সংশোধনের সময় আরও কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল—যেমন ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ে দিলে পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে পরিবার বা মা ভিজিএফ বা ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় আসার যোগ্য তার আর্থ–সামাজিক অবস্থাই তো দুর্বলতম। সেই পরিবারকে নিরাপত্তার আওতা থেকে বাদ দিলে ঝুঁকি আরও বাড়বে, কমবে না।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী নানা মডেল ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও, এর হার খুব একটা কমেনি। বরং কোভিড–১৯–এর পর অনেক দেশে এটি বেড়েছে। বাংলাদেশেও ২০০০ সালের পর থেকে একাধিক প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি চালু হয়েছে, ১৯২৯ সালের আইন ২০১৭ সালে হালনাগাদ করা হয়েছে। তবু ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে ৬৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে—যা ২০২১ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। ১৫ বছরের নিচে মেয়ের বিয়ের হার বেড়েছে ৮ শতাংশ, যা আগে ছিল ৫ শতাংশ।
বাল্যবিবাহ কেন হয়, তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ আমাদের জানা। তবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের নামে কোনো শিশুকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ন্যায্য নয়। একজনের অপরাধে আরেকজনের শাস্তি মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী।

লেখক: উন্নয়ন কর্মী