২৪ মিলিয়ন ডলারের ক্লাউড থেকে ৬ মিলিয়ন ডলারের সেবা: যেভাবে হিতে বিপরীত হলো বাংলাদেশ–ওরাকল চুক্তি
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওরাকলের সঙ্গে তিন বছরের জন্য ১৮ মিলিয়ন ডলার চুক্তিতে 'ডেডিকেটেড ন্যাশনাল ক্লাউড' নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। এই চুক্তিকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের 'স্মার্ট বাংলাদেশ' ভিশনের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
আঠারো মাস পর প্রকল্পটি ঘিরে এখন তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। প্রকল্প-সংক্রান্ত কিছু সরকারি নথি ও চিঠিপত্র টিবিএসের হাতে এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্প পরিচালনাকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড (বিডিসিসিএল) কর ও শুল্কসহ প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করলেও প্রকল্প থেকে ৬ মিলিয়ন ডলারেরও কম মূল্যের সেবা পেয়েছে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে সই হওয়া ওই চুক্তিতে বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড (বিডিসিসিএল) কঠোর পেমেন্ট শর্ত, ব্যয়বহুল আমদানিতে বাধ্যবাধকতাসহ এমন কিছু সেবার শর্তে রাজি হয়, যা কর্মকর্তারা 'রেস্ট্রিকটিভ' বা 'সীমাবদ্ধতামূলক' বলে মনে করছেন। এসব শর্তের কারণে সংস্থাটি বেসরকারি খাতে ক্লাউড সেবা দিতে পারছে না।
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এবং বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক আল মাহমুদসহ একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ওরাকলকে পাঠানো চিঠিতে এ ব্যবস্থাপনাকে 'টেকসই নয়' বলে উল্লেখ করেছেন এবং চুক্তির ১০টি ধারা সংশোধনের জন্য কোম্পানিটিকে আহ্বান জানিয়েছেন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টিবিএসকে বলেন, "আমরা ওরাকলের সঙ্গে আলোচনা করছি, তারা আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে।"
তবে ওরাকল বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান) রুবাবা দৌলা এ বিষয়ে টিবিএসের পাঠানো ইমেইলের জবাব দেননি। ৩১ অক্টোবর তারিখে তাকে পাঠানো এক বার্তায় ওরাকলের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায়নি।
হিতে বিপরীত ফল দিচ্ছে যে চুক্তি
'স্মার্ট বাংলাদেশ'–এর প্রধান উদ্যোগগুলোর একটি হিসেবে যাত্রা শুরু করা এ প্রকল্পটি এখন পরিণত হয়েছে এক সতর্কবার্তায়—যেখানে স্থানীয় নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া বৈশ্বিক প্রযুক্তি গ্রহণের উচ্চমূল্যের বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মোট চুক্তিমূল্য ১৮ মিলিয়ন ডলার, যা তিন বছর মেয়াদে (২০২৭ পর্যন্ত) যথাক্রমে ৩ লাখ, ৬ লাখ ও ৯ মিলিয়ন ডলারের বার্ষিক পেমেন্টে ভাগ করা হয়েছে। তবে কর ও আমদানি শুল্ক যোগ করার পর বিডিসিসিএলের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলারে। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পেয়েছে টিবিএস।
চুক্তি অনুযায়ী, ওরাকলের সরকার–সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর জন্য ক্লাউড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সেবা সরবরাহের কথা ছিল, যেন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি তথ্য দেশের মধ্যেই সংরক্ষিত থাকে এবং একই সঙ্গে ওরাকলের বৈশ্বিক প্রযুক্তি ব্যবস্থার সুবিধা নেওয়া যায়।
কিন্তু ২০২৫ সালের শুরুর দিকেই কর্মকর্তারা সতর্ক করতে শুরু করেন, চুক্তির কাঠামো 'বাণিজ্যিকভাবে টেকসই নয়' এবং এটি ওরাকলের পক্ষে অতিমাত্রায় একপেশে। এক অভ্যন্তরীণ নথিতে সংক্ষেপে বলা হয়, ২৪ মিলিয়ন ডলারের ক্লাউড প্রকল্প যদি মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলারের সেবা দেয়, তবে সেটি ডিজিটাল রূপান্তর নয়, বরং ডিজিটাল নির্ভরতা।
২০২৫ সালের ৫ মে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ওরাকল বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠান।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, যে প্রকল্পে ২৩.৯৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু আয় হচ্ছে ৬ মিলিয়ন ডলারেরও কম, সেটি টেকসই না হলে আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত একটি অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে দেখা যায়, বিডিসিসিএল প্রথম বছরে ওরাকলের সেবা ব্যবহার করেছে মাত্র ৭২ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৩.৮২ মিলিয়ন ডলার—যা মোট ১৮ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির তুলনায় অনেক কম।
আইসিটি বিভাগের গোপন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আয় ও ব্যবহার, চুক্তিতে নির্ধারিত প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মেয়াদ শেষে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতে পারে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের চিঠিতে ওরাকলকে চুক্তির শর্তগুলো পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে উভয় পক্ষের স্বার্থ ও দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়।
অন্যদিকে, ওরাকল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী রুবাবা দৌলা সেবার জন্য পাওনা অর্থ পরিশোধের দাবি জানিয়েছেন। টিবিএসের দেখা চিঠিটি চলতি বছরের ৬ অক্টোবর তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের উদ্দেশে পাঠানো হয়। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, বিডিসিসিএলের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সেবা প্রদান করলেও এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ পায়নি ওরাকল।
তিনি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি 'জরুরি বৈঠকের' অনুরোধ করেন।
মালিকানা ছাড়াই হার্ডওয়্যারের শুল্ক পরিশোধ
ওরাকলের হার্ডওয়্যার আমদানির শর্ত নিয়েই উঠেছে মূল আপত্তি। 'ডেডিকেটেড রিজিয়ন ক্লাউড অ্যাট কাস্টমার' প্রকল্পের সব সরঞ্জামের মালিকানা ওরাকলের থাকলেও, আমদানিকারক হিসেবে বিডিসিসিএলকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে মোট ৩.৬৮ মিলিয়ন ডলার শুল্ক ও কর পরিশোধ করতে হয়েছে।
আইসিটি বিভাগের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিডিসিসিএল এমন সরঞ্জামের জন্য অর্থ পরিশোধ করেছে, যার মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ তাদের নেই। এটি আন্তর্জাতিক প্রচলিত নিয়মের পরিপন্থী; এখানে হার্ডওয়্যারের মালিক প্রতিষ্ঠানকেই এমন ব্যয় বহন করতে হয়।
একই মাসের শেষের দিকে পাঠানো আরেক চিঠিতে বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনুষ্ঠানিকভাবে ওরাকলের কাছে এই শুল্কের অর্থ ফেরত দেওয়ার বা ভবিষ্যৎ পেমেন্টের সঙ্গে তা সমন্বয় করার অনুরোধ জানান।
প্রাথমিক আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ২০২৪ সালে নির্বাচনের আগে দ্রুত চুক্তি চূড়ান্ত করার চাপের মধ্যে এই 'ইম্পোর্টার অব রেকর্ড' ধারা গৃহীত হয়েছিল।
ওরাকলের 'অ্যানুয়াল ইউনিভার্সাল ক্রেডিট' ব্যবস্থার আওতায় বিডিসিসিএলকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ—প্রথম বছরে ৩ মিলিয়ন, দ্বিতীয় বছরে ৬ মিলিয়ন এবং তৃতীয় বছরে ৯ মিলিয়ন ডলার—পরিশোধ করতে হয়, এক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যবহার যা-ই হোক না কেন। আর অব্যবহৃত ক্রেডিটের মেয়াদ প্রতি বছর শেষে শেষ হয়ে যায়, অর্থাৎ বিডিসিসিএল এমন সেবার জন্য অর্থ দিচ্ছে যা তারা ব্যবহারই করছে না।
আইসিটি বিভাগের এক আর্থিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রথম বছরে বিডিসিসিএলের প্রকৃত ব্যবহার ছিল মাত্র ২.১৫ মিলিয়ন ডলার, যা কেনা ক্রেডিটের প্রায় ৭০ শতাংশ।
বিডিসিসিএল প্রস্তাব দিয়েছে, অব্যবহৃত ক্রেডিট যেন পরবর্তী বছরে স্থানান্তর করা যায় এবং বাজারদরের সঙ্গে যেন মূল্য সমন্বয় করা হয়—যা তাদের হিসাবে ওরাকলের নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বিডিসিসিএল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ওরাকলের 'ডেডিকেটেড রিজিয়ন ক্লাউড অ্যাট কাস্টমার (ডিআরসিসি)' সেবা দিতে পারবে না। এই অবকাঠামো কেবল সরকার বা সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতেই ব্যবহার করতে হবে।
ওরাকলকে পাঠানো চিঠিতে বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই সীমাবদ্ধতা সংশোধনেরও প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে সংস্থাটি বেসরকারি খাতকেও সেবা দিতে পারে।
তবে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রস্তাবের বিষয়ে ওরাকলের পক্ষ থেকে কোনো প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
রাজনৈতিক তাড়াহুড়োয় সম্পন্ন করা হয় চুক্তি
চুক্তিটি বর্তমানে ইংলিশ আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে এবং এর সালিশের কেন্দ্র নির্ধারিত হয়েছে লন্ডনে। এটি ওরাকলের বৈশ্বিক চুক্তিগুলোর জন্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও এখন সরকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একে দেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে প্রশ্ন হিসেবে দেখছেন।
বিডিসিসিএল প্রস্তাব দিয়েছে, ভবিষ্যতে চুক্তি–সংক্রান্ত যেকোনো বিরোধ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা হোক এবং সালিশি প্রক্রিয়া ঢাকাস্থ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে (বিআইএসি) অনুষ্ঠিত হোক।
কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই এমন চুক্তিগুলো স্থানীয় আইনি কাঠামোর আওতায় নিয়ে এসেছে, যাতে বিচারিক এখতিয়ার নিজ দেশের ভেতরেই থাকে।
ওরাকলের সঙ্গে যখন এই চুক্তিটি সই হয়, তখন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জুনাইদ আহমেদ পলক। বর্তমানে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে বিচারিক তদন্তের মুখোমুখি।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ওরাকলের সঙ্গে চুক্তিটি 'রাজনৈতিক তাড়াহুড়োয়' সম্পন্ন করা হয়; আর্থিক বা আইন বিশেষজ্ঞদের যথাযথ পর্যালোচনা ছাড়াই চূড়ান্ত করা হয়েছিল চুক্তিটি।
ওরাকলের কাছে আমদানি শুল্ক ফেরত চায় বিডিসিসিএল
বিডিসিসিএলের চিঠিপত্র অনুযায়ী, ওরাকলের সঙ্গে করা চুক্তির ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ধারা এখন পুনর্বিবেচনাধীন। সংস্থাটি ওরাকলের কাছে দাবি জানিয়েছে, যে সরঞ্জামের মালিকানা এখনও বিক্রেতার কাছেই রয়েছে, তার জন্য পরিশোধিত আমদানি শুল্ক ফেরত দিতে হবে। একই সঙ্গে অব্যবহৃত ক্লাউড ক্রেডিট যেন এক বছর থেকে পরের বছরে স্থানান্তর করা যায়—এ দাবিও জানানো হয়েছে।
বিডিসিসিএল আরও প্রস্তাব দিয়েছে, সেবার মূল্য যেন আঞ্চলিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা হয় এবং যথাযথ নিয়ন্ত্রক তত্ত্বাবধানে বেসরকারি খাতেও সেবা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়।
প্রস্তাবিত অন্যান্য পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট নবায়ন ফি বাতিল, অর্থপ্রদানের সময়সীমা ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৯০ দিন করা, এবং উভয় পক্ষের জন্য সমানভাবে চুক্তি বাতিলের অধিকার নিশ্চিত করা।
এছাড়া বিডিসিসিএল চুক্তি শেষে ডেটা সংরক্ষণের মেয়াদ দীর্ঘ করার পাশাপাশি ইংলিশ আইনের পরিবর্তে বাংলাদেশের আইনে সালিশ প্রক্রিয়া পরিচালনার এবং ব্যয়বহুল ব্যাংক গ্যারান্টির পরিবর্তে রিনিউবেল পে অর্ডার ব্যবহারের প্রস্তাবও দিয়েছে।
