গণভোট কবে? নতুন দ্বন্দ্বে রাজনীতি অস্থির, সময় নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য
জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে প্রস্তাবিত গণভোটের সময়সূচি ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের অস্থিরতা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর।
এদিকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত রয়েছে জাতীয় নির্বাচনের সময়। কিন্তু, নতুন করে শুরু হওয়া রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিভাজনের মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সে সময় ঘনিয়ে আসলেও—এখনো ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে না পারায় ব্যবসায়ী নেতা, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের প্রতিবেদনে প্রস্তাব করেছে, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে অথবা নির্বাচনের দিনেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে জামায়াতে ইসলামী চায় গণভোট নির্বাচনের আগে হোক, আর বিএনপি চায় নির্বাচনের দিনেই — দুটি আলাদা ব্যালটে ভোট অনুষ্ঠিত হোক।
আজ বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।
নির্বাচনের দিনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান তার দল কখনোই মানবে না জানিয়ে তিনি বলেন, সময়স্বল্পতা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগসহ একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজন বিবেচনায়—নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে ও একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।
অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বিএনপির প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, "বিএনপি চাইলে তাদের মতো প্রস্তাব দিতে পারে, কিন্তু আমরা চাই নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট হোক।"
নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে থাকা এনসিপি-ও একই দাবি জানিয়ে বলেছে, জুলাই সনদ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেশে কোনো নির্বাচন হতে পারে না।
রাজনৈতিক বিভাজন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি
এদিকে ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত করছে। তারা বলেছেন, সময়মতো নির্বাচন না হলে ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা আরও নষ্ট হবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ ও বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান একে "অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক বিভাজন" বলে অভিহিত করেছেন।
আনোয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গণভোট নিয়ে জটিলতা দ্রুত মেটাতে হবে এবং ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের বিলম্ব ব্যবসায়িক আস্থা ভেঙে দেবে, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।"
ফজলে শামীম এহসান বলেন, "বিভিন্ন অজুহাতে যারা নির্বাচনে বাধা দিচ্ছে, তারা দেশের অর্থনীতি ও জাতির শত্রু। নির্বাচিত সরকার না এলে বিনিয়োগ থেমে যাবে, অর্থনীতি থমকে যাবে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ইতোমধ্যেই অবনতি হচ্ছে—এখনই কর্মসংস্থান নেই, বিনিয়োগ নেই, এমনকি বিভিন্ন দেশের ভিসা রেস্ট্রিকশন চলছে। তাই দ্রুত নির্বাচিত সরকার অপরিহার্য। নাহলে এসব সমস্যা আরও তীব্র হবে।"
'অনিশ্চয়তা আর চলতে পারে না'
২০২৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। তাই ব্যবসায়ী নেতারা জোর দিয়েছেন একটি স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর।
টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, "আমরা চাই ফেব্রুয়ারিতে বা যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হোক, এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারসম্পন্ন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করুক। তাহলে আমরাও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারব।"
তিনি বলেন, "রাজনৈতিক সরকার ছাড়া স্থিতিশীল পরিবেশ অসম্ভব। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও অনিশ্চয়তার কারণে এই মার্কেটে আসতে চাইছে না। এরকম অনিশ্চয়তা চলতে পারে না। আমরা চাই সব অনিশ্চয়তা দূর হোক, এবং স্থিতিশীল একটি নির্বাচিত সরকার গঠিত হোক।"
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও গণভোটের বিষয়টি নতুন করে রাজনৈতিক বিভাজন, অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এর ফলে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ইতোমধ্যেই অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)- এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে সবাই আশা করেছিল যত দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, দেশের জন্য ততই ভালো হবে। কিন্তু গত এক বছরে সংস্কার ও বিভিন্ন কমিশন গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির পরিবর্তে সরকার বরং বিভাজন সৃষ্টি করেছে, যা জাতীয় স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করেছে।"
তিনি বলেন, জনগণের মধ্যেও সন্দেহ বাড়ছে—নির্বাচন আদৌ হবে কিনা, আর হলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না। একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হলে তার ভয়াবহ ফলাফল পড়বে ব্যবসা ও নাগরিক জীবনে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, "সবাই ধরে নিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, সেসব বিষয়ে গণভোট হবে। সবাই এটার জন্য প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু এখন যেভাবে নোট অব ডিসেন্টে থাকা বিষয়গুলোকেও গণভোটের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, এমন বিতর্কিত গণভোটের জন্য কোনো দল প্রস্তুত ছিল না। এটা খুবই সন্দেহজনক ও শঙ্কাজনক।"
তিনি আরও বলেন, "এর মধ্য দিয়ে জনগণকেও বিপদের মধ্যে ফেলছে সরকার। হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছে ৪৮টি বিষয়ে মতামত চাওয়া হচ্ছে। একটি ভোটের মাধ্যমে এতগুলো বিষয়ে মতামত দেওয়া জনগণের জন্যও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।"
কতটা বাস্তবসম্মত?
এখন মূল প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট আয়োজন আদৌ কতটা বাস্তবসম্মত বা কার্যকর হবে?
এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন বলেন, "জুলাই সনদের বিভিন্ন ধারায় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এক নয়। যদি ভোটাররা প্রতিটি ধারায় আলাদাভাবে মত দিতে না পারে, বরং গোটা সনদে কার্যকর/ বাতিলের পক্ষে 'হ্যাঁ' বা 'না' ভোট দিতে হয়, তবে তারা কীভাবে সঠিকভাবে মত প্রকাশ করবে?"
তিনি বলেন, "সনদ অনুমোদিত হলেও বিতর্ক শেষ হবে না। সাধারণ ভোটাররা এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে কতটা অবগত, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। ধারাগুলোর সম্পর্কে না জেনে কীভাবে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন? এসব কারণে গণভোটের বৈধতা ঘিরে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে।"
মহিউদ্দিন আরও যোগ করেন, " অন্তর্বর্তী সরকারের সত্যিকারের উদ্দেশ্য যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতো, তাহলে বিএনপির উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে সংলাপের পথ তৈরি করা যেত। কিন্তু বর্তমান প্রক্রিয়ার গতি ও ধরন দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এটি কি সত্যিই নির্বাচনের পথে, নাকি অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলের অংশ?"
