মানিকগঞ্জে পদ্মার শাখা নদী-খালে কুমিরের বিচরণের দাবি, আতঙ্কে স্থানীয়রা

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মার শাখা নদী ও খালে কুমির দেখা গেছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয়রা। প্রায় এক মাস ধরে নদী ও খালের বিভিন্ন স্থানে কুমির দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
১৯ অক্টোবর দুপুরে হরিরামপুরের হারুকান্দি ইউনিয়নের তন্ত্রখোলা গ্রামে খালপাড়ে শতাধিক উৎসুক মানুষ ভিড় করেন একটি কুমির দেখার জন্য। কারও মুখে কৌতূহল, কারও মুখে আতঙ্ক। স্থানীয়দের দাবি, ওই খালে কুমিরটিকে ভেসে থাকতে দেখা গেছে দুপুর পর্যন্ত।
প্রথমদিকে ধুলশুড়া ইউনিয়নের বোয়ালী ও মাদবরবাড়ি খেয়াঘাটে কুমিরের দেখা মেলার কথা শোনা গেলেও রবিবার (১৯ অক্টোবর) তন্ত্রখোলা খালে কুমিরের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন এলাকাবাসী।
গ্রামের নদী-খালে কুমিরের এমন বিচরণে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করছেন, নদীতে একাধিক কুমির আছে। তারা দ্রুত কুমিরগুলোকে উদ্ধার বা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
হরিরামপুর উপজেলা বন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত) মো. শরিফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। যদিও কুমিরটি চোখে দেখিনি, তবে স্থানীয়দের ধারণ করা ছবি ও ভিডিও দেখে নিশ্চিত হয়েছি এটি মিঠাপানির কুমির।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা একাধিকবার এলাকায় গিয়েছি কুমিরের সন্ধানে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এবারই প্রথম এমন কুমির দেখেছেন তারা। তবে এখনো কুমিরের অবস্থান বা সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি।'
তিনি জানান, বিষয়টি বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটকে জানানো হয়েছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি স্থানীয়দের কুমিরকে আঘাত না করা ও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, গত এক মাস ধরে সদর উপজেলার চর বংখুরি ও হরিরামপুর উপজেলার ধুলশুড়া, বোয়ালী, আইলকুণ্ডি, বাবুরহাঁটি, খামারহাঁটি, বাকিহাঁটি, হারুকান্দি, কাশিয়াখালি ও তন্ত্রখোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পদ্মার শাখা নদী ও খালে কুমিরের দেখা মিলছে।
তন্ত্রখোলা বাইতুল নুর জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা পারভেজ হাসান বলেন, 'গত কয়েকদিন ধরেই এলাকায় কুমিরের খবর শুনছিলাম। কিন্তু আজ ভোরে প্রথমবার নিজ চোখে দেখি। ফজরের নামাজের পর রাস্তায় হাঁটার সময় খালের দক্ষিণ দিক থেকে ধীরে ভেসে আসতে দেখি কুমিরটিকে। লোকজন জড়ো হলে এটি পানিতে ডুব দেয়, আবার পাশের ভেশালের পাশে উঠে আসে। দুপুর পর্যন্ত সেখানেই ছিল।'
পারভেজ হাসান যেখানে কুমির দেখেছেন, সেখান থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরেই পদ্মার শাখা নদী।
তন্ত্রখোলা খালের অপর পাশে ভেশাল পেতে মাছ ধরছিলেন স্থানীয় জেলে গোবিন্দ। তিনি বলেন, 'দুই মাস ধরে এখানে মাছ ধরছি। আজই প্রথম কুমির দেখলাম। কিছুদিন আগে ইছামতি নদীতেও কুমির দেখেছিলাম।'
তন্ত্রখোলা এলাকার অন্তত ১০–১২ জন স্থানীয়ের সঙ্গে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানতে পেরেছে, তাদের মধ্যে অন্তত চারজন নিজ চোখে কুমির দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। তবে কুমিরের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে; কেউ বলছেন একটি, কেউ বা একাধিক। অধিকাংশের মতে, দেখা কুমিরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬–৭ হাত।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদক তন্ত্রখোলা, বোয়ালীসহ পদ্মার শাখা নদীর আশপাশের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন। স্থানীয়দের কেউ কেউ কুমির দেখেছেন বলে জানান, আবার কেউ বলেন, আতঙ্কে তারা এখন নদী-খালে নামছেন না।
স্থানীয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সহকারী সঞ্জিত বসাক বলেন, 'কুমির আতঙ্কে নদীতে গোসল, গবাদিপশুর স্নান; সবকিছুই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে কুমির দেখার খবর আসছে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রায় এক মাস ধরে কুমির দেখা যাচ্ছে। প্রথমে আইলকুণ্ডি ও বোয়ালী এলাকায় দেখা গেলেও গত ১৫ দিনে সেখানে আর দেখা মেলেনি, এখন দেখা যাচ্ছে অন্য এলাকায়।'

তিনি জানান, সম্প্রতি বন বিভাগের এক কর্মী বোয়ালী খেয়াঘাট এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের কুমিরকে আঘাত না করে বন বিভাগে খবর দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মনিরুল এইচ খান বলেন, 'সম্প্রতি যেসব মিঠাপানির কুমিরের দেখা মিলছে, তা সম্ভবত ভারত থেকে এসেছে।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে মিঠাপানির কুমির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে যেগুলো এখন দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সম্ভবত পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে নদীপথে এসেছে।'
ড. খান জানান, কুমিরের এ ধরনের মাইগ্রেশন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, 'প্রাণী নিজের নতুন আবাসস্থল খোঁজে। কোনো জায়গায় খাদ্য বা প্রজনন সংকট তৈরি হলে তারা অন্যত্র যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশে যদি নিরাপদ আবাসস্থল থাকে, তবে এরা এখানে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। জেলেদের জালে আটকা পড়া বা লোকজনের তাড়ানোর কারণে তারা স্থায়ী হতে পারে না।'
রাজশাহীর পদ্মা নদীতে কুমিরের দেখা পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ওই এলাকা কুমির, ঘড়িয়াল ও জলচর পাখির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এলাকাটি সংরক্ষিত ঘোষণা করে সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে এসব প্রাণীকে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর কোথাও লোকালয়ে ঢুকে পড়লে কুমিরগুলোকে উদ্ধার করে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।'