দেশের গ্যাসক্ষেত্রে ফুরিয়ে আসছে মজুত, বাড়ছে এলএনজি আমদানি
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এর ফলে শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে দেশ ব্যয়বহুল স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে এবং অব্যবহৃত মজুত থেকে উৎপাদন শুরু না হলে আগামী আট বছরের মধ্যে দেশের স্থানীয় সরবরাহ ফুরিয়ে যেতে পারে।
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৯.৭৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুতের মধ্যে ২১.০৮ টিসিএফ ইতিমধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল মাত্র ৮.৬৬ টিসিএফ।
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটে (এমএমসিএফডি) নেমে এসেছে, যা ২০১৭ সালের ২,৭০০ এমএমসিএফডির তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কম।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান বলেন, 'স্থানীয় উৎপাদন কমছে, কিন্তু সব খাতে চাহিদা বাড়ছে। এই ঘাটতি মেটাতে এলএনজি আমদানি বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।'
রেকর্ড এলএনজি আমদানি
২০২৫ সালে এলএনজি আমদানি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) স্পট মার্কেট থেকে ৩৫টি এলএনজি কার্গো আমদানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২১টি।
শুধু আগস্টেই রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটি ৩,৪২৭ এমএমসিএফ এলএনজি কিনেছে—যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ৫৬টি কার্গো আমদানির অনুমতি রয়েছে পেট্রোবাংলার। কিন্তু এ বছর পরিকল্পিত ১০৮টি চালানের বাকি ৫২টি অবশ্যই ব্যয়বহুল স্পট মার্কেট থেকে আনতে হবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সংস্থাটি প্রায় ৫৮০ বিলিয়ন টাকা ব্যয়ে ১১৫টি কার্গো আমদানির আশা করছে।
এদিকে আমদানিকৃত গ্যাসের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা সরকারের ভর্তুকির বোঝা আরও বাড়িয়েছে।
উচ্চ আমদানি মূল্য এবং দেশের বাজারে কম দামের মধ্যে ব্যবধান মেটাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা গ্যাস ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা।
স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে চাপ কমছে
উৎপাদন কমার প্রধান কারণগুলো হলো মজুত ফুরিয়ে আসা, অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং অনুসন্ধান ও কূপ উন্নয়নে বিলম্ব।
তিতাস, বিবিয়ানা ও রশীদপুরের মতো প্রধান গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের চাপ ক্রমাগত কমছে। ২০২৫ সালের জুন নাগাদ সামগ্রিক দেশীয় উৎপাদন ১,৮৫০ এমএমসিএফডিতে নেমে এসেছে।
এলএনজি আমদানি সত্ত্বেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট গ্যাস বিতরণ কমে ২,৫২৬ এমএমসিএফডিতে দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ২,৭১৫ এমএমসিএফডি। দেশীয় গ্যাসে প্রতি ঘনমিটারে খরচ পড়ে প্রায় ৩ টাকা, যেখানে আমদানিকৃত এলএনজির খরচ প্রায় ৫৫ টাকা।
পেট্রোবাংলা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মিশ্রিত ব্যয় হিসাব করেছে ১৯.০৯ টাকা, যেখানে ওয়েটেড গড় বিক্রয়মূল্য ১১.৯১ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ৭.১৮ টাকা।
অনুসন্ধানে ধীরগতি
বাংলাদেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ২০টি সক্রিয় রয়েছে। ২০১০ সালের সর্বশেষ বড় মজুত মূল্যায়নে মোট উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২৮.৭৯ টিসিএফ।
প্রধান উৎপাদনকারী গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসে প্রায় ২ টিসিএফ ও হবিগঞ্জের বিবিয়ানায় ১.৬৬ টিসিএফ মজুত রয়েছে।
ইলিশা, ভোলা উত্তর, জকিগঞ্জ ও কুতুবদিয়ার মতো ক্ষেত্রগুলো থেকে এখনও গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়নি। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও সীমিত অর্থায়নের কারণে এগুলোর উন্নয়ন কাজ হয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৩১টি কূপ সংস্কারসহ মোট ১০০টি নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা করেছে, যা জাতীয় গ্রিডে প্রায় ৬৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস যোগ করবে।
পেট্রোবাংলার মিজানুর রহমান বলেন, 'বেশিরভাগ কূপের চুক্তি সই হয়ে গেছে। কিছু ওয়ার্কওভার কূপ শীঘ্রই উৎপাদনে আসবে। আশা করছি, সেগুলো থেকে প্রায় ১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস পাওয়া যাবে।'
বাপেক্সের অর্থ সংকট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের গতি নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। সর্বশেষ বড় আবিষ্কার ছিল ১৯৯৮ সালে বিবিয়ানা ক্ষেত্র, আর ২০২১ সালের পর থেকে জকিগঞ্জ নামে মাত্র একটি ছোট ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানিকে (বাপেক্স) শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা বছরের পর বছর ধরে থমকে আছে।
আনুমানিক ৩.৫ থেকে ৪ বিলিয়ন টাকা ব্যয়ে একটি নতুন ড্রিলিং রিগ কেনার পরিকল্পনা ঝুলে আছে। সংস্থাটি সর্বশেষ বড় কোনো সরঞ্জাম কিনেছিল ২০১২ সালে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, 'বাপেক্স কয়েক দশক ধরে তহবিল সংকটে ভুগছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য একে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকার যদি জ্বালানি নিরাপত্তা চায়, তবে অবশ্যই দেশীয় অনুসন্ধানে যথাযথভাবে বিনিয়োগ করতে হবে।'
চাপে শিল্প খাত
দেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাস সংকট ইতিমধ্যে শিল্প খাতকে মারাত্মক চাপে ফেলেছে। অনেক কারখানা তাদের চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশেরও কম গ্যাস পাচ্ছে; ফলে তারা পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা ৯৭৬ এমএমসিএফডি প্রাক্কলন করা হলেও, প্রকৃত সরবরাহ ছিল ৫৬০-৬০০ এমএমসিএফডির আশেপাশে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের মোট চাহিদা প্রতিদিন ৪ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফডি) ছাড়িয়েছে, অথচ দেশীয় উৎপাদন ২.৭ বিসিএফডির নিচে।
গ্যাসের দামও বেড়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিগত সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছিল। এরপর চলতি বছর নতুন সংযোগের জন্য দাম আরও ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
