নতুন রিগ ক্রয় ও ভোলায় গ্যাস অনুসন্ধানে ২,১৩৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমাতে ২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর একটি হলো ২,০০০ হর্সপাওয়ার রিগ (প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনে ব্যবহৃত খননযন্ত্র) কেনা, অপরটি হলো ভোলার পাঁচ গ্যাসকূপ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন।
গতকাল (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এই প্রকল্প দুটির পাশাপাশি আরও ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৮ হাজার ৩৩২.২৮ কোটি টাকা।
মোট ব্যয়ের মধ্যে ৪ হাজার ৪৩৭.৮২ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে, ১ হাজার ২২৫.৩৬ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা হিসেবে এবং বাকি ২, হজার ৬৭০.০৯ কোটি টাকা বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে।
সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) জন্য একটি নতুন রিগ কেনা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই কোম্পানির বর্তমানে কয়েকটি রিগ থাকলেও সেগুলো অপর্যাপ্ত, ফলে বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয়।
ভোলায় গ্যাস অনুসন্ধান প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভোলা অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য একটি নতুন প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এই এলাকাকে সম্ভাব্য গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে কয়েকটি পর্যায়ে অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়েছে এবং নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে অনুসন্ধান ও কূপ খননের কাজ আরও এগিয়ে নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এলএনজিনির্ভরতা কমাতে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানো জরুরি। এজন্য বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ভোলায় নতুন উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাপেক্সের জন্য ২,০০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতার একটি রিগ কেনার প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৭৭.২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫২০ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে এবং বাকি টাকা কোম্পানির নিজস্ব তহবিল থেকে আসবে।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে বাপেক্স ২০২৮ সালের মধ্যে ৫৬টি কূপ খনন ও ১৬টি কূপের ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা করেছে। বর্তমানে বাপেক্সের দুটি ড্রিলিং রিগ ও একটি ওয়ার্কওভার রিগ রয়েছে; আর বাড়তি অতিরিক্ত ড্রিলিং রিগ আপগ্রেড করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যা কূপ খননের জন্য যথেষ্ট নয়।
অন্যদিকে ভোলার পাঁচটি কূপের প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৫৫.৬৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১ হাজার ২৪৪.৮০ কোটি টাকা সরকারি তহবিল ও বাকি অংশ কোম্পানির নিজস্ব তহবিল থেকে আসবে। এই প্রকল্পের আওতায় শাহবাজপুর ক্ষেত্রের দুটি কূপ—শাহবাজপুর-৫ ও শাহবাজপুর-৭—এবং ভোলা উত্তর ক্ষেত্রের দুটি কূপ—ভোলা উত্তর-৩ ও ভোলা উত্তর-৪-এর মূল্যায়ন ও উন্নয়ন করা হবে। পাশাপাশি শাহবাজপুর উত্তর-পূর্ব-১ নামে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। গত ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র ঘোষণা করা হয়, যা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ আগামী বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি।
পেট্রোবাংলার গ্যাস রিজার্ভ প্রতিবেদন অনুসারে, ভোলা জেলায় এখন পর্যন্ত তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ২পি (সম্ভাব্য ও প্রমাণিত) মজুত সমীক্ষা অনুযায়ী, এর মধ্যে শাহবাজপুরে গ্যাসের মজুত আছে ৬৩৪ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এখান থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে ১৪৩ বিসিএফ গ্যাস। জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে ভোলার গ্যাস পাইপলাইন সংযুক্ত না থাকায় সেখান থেকে উত্তোলিত গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে স্থানীয় কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
ভোলা নর্থ-১ গ্যাস ফিল্ডে আবিষ্কৃত মজুতো প্রায় ৪৩৫ বিসিএফ, ইলিশায় গ্যাসের মজুত পাওয়া গেছে ১৪০ বিসিএফ। গ্যাসক্ষেত্র দুটি ২০১৮ ও ২০২৩ সালে আবিষ্কার হলেও এখানকার গ্যাস ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
সংস্থাটি এখন ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা এবং সেখানে আরো কূপ খনন করে গ্যাস আবিষ্কারের প্রতি জোর দিচ্ছে।
কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আনতে সেখানে আরও গ্যাসের মজুত নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। সে কারণেই গ্যাসকূপ খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ আইন বাতিল হওয়ার সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে এখন উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে এ খননকাজে বিদেশি আরও কোম্পানিকে যুক্ত করতে চাইছে পেট্রোবাংলা।
সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীরা তদারকি করে, এর মানেই এই নয় বৈদেশিক ঋণ প্রকল্পে অনিয়ম হয় না।
তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্পে দেশীয় ও বিদেশি স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাবের কারণেই ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যা বিগত সরকারের সময়ে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি মেট্রোরেল ও মহাসড়কের কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব প্রকল্পে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের খরচ বেশি।
উপদেষ্টা আরও বলেন, সরকার কিছু প্রকল্প বাছাই করে খরচ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে গবেষণা ও প্রকাশনার উদ্যোগও নেওয়া হতে পারে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। এখন সহজ শর্তের ঋণ (কনসেশনাল লোন) ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নমনীয় ঋণ আরও কমে যাবে। তাই এসব ঋণ কেবল অগ্রাধিকারমূলক ও দেশের জন্য অপরিহার্য প্রকল্পগুলোতেই নেওয়া হবে।
খাসজমির তথ্য সংগ্রহে সরকারি কমিটি
এদিকে দেশে কী পরিমাণ খাস (সরকারি মালিকানাধীন) জমি আছে, তা চিহ্নত করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটির গঠন করেছে সরকার। ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিটি দুই মাসের মধ্যে জমির পরিমাণ, অবস্থা, ব্যবহার ও দখল-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, খাস জমিতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে সরকারি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা পরিহার করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, এই কমিটি জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে সারাদেশে জমির মানচিত্র তৈরি করবে, যা কৃষি জমি রক্ষা করার পাশাপাশি অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়নকে সহজ করবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ২.৩৯ শতাংশ।
তিনি জানান, এখনও অনেক প্রকল্পে ঠিকাদার নেই। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর ঠিকাদারা অনেকেই ফেরেনি। আবার সরকারের নতুন ক্রয় বিধিমালা অনুমোদন না হওয়ার কারণে অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দরপত্র আহ্বান করছে না। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে আগামী সপ্তাহে নতুন নীতিমালা অনুমোদন পেতে পারে বলে তিনি জানায়।
উপদেষ্টা আরও বলেন, নতুন ক্রয় বিধি মালায় যুগান্তকরী কিছু সংস্কার আনা হয়েছে, যেখানে বারবার একই প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়া সুযোগ থাকবে না।