ভোলায় মাদ্রাসার ৩০০ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করলেন অফিস সহকারী

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার এক ঐতিহ্যবাহী ফাজিল মাদ্রাসায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করেছেন এক অফিস সহকারী—এমন অবিশ্বাস্য তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে।
প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী কামাল উদ্দিন (মিরাজ) বছরের পর বছর ধরে সরকারের প্রায় অর্ধকোটি টাকা নিজের পকেটে তুলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা ও দুর্বল নজরদারির সুযোগে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে তদন্ত দল।
চার বছরে আত্মসাৎ অর্ধকোটি টাকা
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের শেষের দিকে মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে মাদ্রাসাটিতে যোগ দেন কামাল উদ্দিন। যোগদানের কয়েক মাসের মধ্যেই আইটি বিষয়ে দক্ষতার কারণে উপবৃত্তি বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার হাতে।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর নাম যুক্ত বা কর্তনের অনুমোদন প্রিন্সিপালের মোবাইলে আসা ওটিপি কোড দিয়ে করা হলেও, সব এন্ট্রির দায়িত্ব ছিল কামালের ওপর। এ সুযোগে তিনি শত শত ভূয়া শিক্ষার্থীর নাম সার্ভারে যুক্ত করে দেন।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন, অ্যাডমিট কার্ড, জিপিএ ও ট্রান্সফার সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, কামাল উদ্দিন উপজেলার অন্যান্য মাদ্রাসার একটি প্রতারক চক্রের সহায়তায় ভুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য এসব নথিও জোগাড় করেন।
যেভাবে চলত কারসাজি
পরিদর্শনে দেখা যায়, আলিম (একাদশ) শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছে ৭৩ জন। নিয়মিত উপবৃত্তি পান ৪১ জন। কিন্তু সরকারি ওয়েবসাইটে দেখানো হয়েছে ১৩৩ জন শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে ৯৫ জন উপবৃত্তি পাচ্ছেন।
অর্থাৎ ৫৪ জন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত দেখিয়ে শুধুমাত্র একাদশ শ্রেণি থেকেই বছরে প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। গত চার বছরে এই পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
একইভাবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বাড়িয়ে দেখিয়ে বছরে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আর চার বছরে ১৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।
নবম–দশম শ্রেণিতে অতিরিক্ত একশাধিক শিক্ষার্থী দেখিয়ে বছরে প্রায় ৫ লাখ এবং চার বছরে ২০ লাখ টাকার বেশি তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ফাজিল পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক ভূয়া শিক্ষার্থীর নামে তিনি তুলে নিয়েছেন ৫০–৫৫ লাখ টাকা।
তদন্ত ও প্রশাসনের বক্তব্য
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, 'প্রতিষ্ঠানটির উপবৃত্তি সংক্রান্ত অনিয়মে ঢাকা থেকে তদন্ত দল এসে গেছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রিন্সিপাল স্বীকার করেছেন, পাসওয়ার্ড তার দায়িত্বে থাকার কথা। তবে অফিস সহকারি অনলাইন প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে এমন কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। নকল শিক্ষার্থীর নামে রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও পিতামাতার তথ্য কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি তদন্তে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।'
প্রিন্সিপালের দাবি
মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আল-আমিন বলেন, 'ঢাকা থেকে পরিদর্শক দল এসে উপবৃত্তি সংক্রান্ত বেশ কিছু অনিয়ম পেয়েছেন, যা সবই অফিস সহকারী কামাল উদ্দিনের মাধ্যমে হয়েছে। তিনি আইডিতে পারদর্শী হওয়ায় দায়িত্ব তার হাতে দেওয়া হয়েছিল। তবে ওটিপি আমার ফোনে আসতো, আমি তাকে কোডটি দিতাম—তবে এতে দুর্নীতির সুযোগ আছে, তা বুঝতে পারিনি।'
তিনি আরও জানান, তদন্ত টিমের সুপারিশে কামাল উদ্দিনকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। 'চূড়ান্তভাবে তার চাকরি চলে যেতে পারে,' বলেন তিনি।
অভিযুক্তের গা ঢাকা
অফিস সহকারী কামাল উদ্দিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার সরেজমিনে মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, সাময়িক বরখাস্ত থাকা সত্ত্বেও কামাল উদ্দিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদককে দেখে দ্রুত মাদ্রাসা ত্যাগ করেন তিনি।
অডিটের খবরে হুড়োহুড়ি
গত আগস্টে ঢাকার পরিদর্শক দল বোরহানউদ্দিনের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে আসবে—এমন খবর পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন কামাল উদ্দিন। তিনি বাড়িতে বসে অফিসের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সেন্ট্রাল ওয়েবসাইট থেকে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম কেটে দেন।
কিন্তু নাম মুছে ফেলতে গিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি—কারণ, একবার নাম মুছে ফেললে তা পুনরায় যুক্ত করা যায় না। এতে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বন্ধ হয়ে যায় এবং শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। ফলে ভুয়া শিক্ষার্থীর পাশাপাশি প্রায় শতাধিক প্রকৃত শিক্ষার্থীর নামও অনলাইন সিস্টেম থেকে বাদ পড়ে যায়।
সে সময়ে পরিদর্শক দল অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ঘুরে গেলেও ওই ফাজিল মাদরাসায় যাননি। তবে ঢাকা ফিরে মূল সার্ভারে বোরহানউদ্দিনের একটি মাদরাসার উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা হঠাৎ কমে যাওয়ায় তাদের সন্দেহ হয়। পরে তারা চিঠি দিয়ে পরিদর্শনে আসার ঘোষণা দেন এবং পরিদর্শনে এসে নানা অনিয়মের প্রমাণ পান।
তদন্তে উন্মোচিত জালিয়াতির কৌশল
গত ১৪ সেপ্টেম্বর পরিদর্শক দল সরেজমিনে গিয়ে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থী সংখ্যা ও ওয়েবসাইটের তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের গরমিল খুঁজে পান। বাস্তবে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছিলেন ৪৫০ জন, অথচ অফিস সহকারী কামাল দেখিয়েছিলেন ৭৫০ জনের বেশি।
তদন্তে আরও জানা যায়, ভুয়া শিক্ষার্থীর নামে ভিন্ন ভিন্ন মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছিল। এসব নম্বরে যোগাযোগ করলে অনেকগুলো বন্ধ পাওয়া যায়, আবার কিছু নম্বর অন্য কেউ ব্যবহার করছে। এতে স্পষ্ট হয় যে এটি পরিকল্পিত প্রতারণা। এমনকি শিক্ষার্থীর নাম ও অভিভাবকের নাম ঠিক থাকলেও এমএফএস নম্বরটি ছিল অফিস সহকারী কামালের নিজের, ফলে উপবৃত্তির অর্থ যেত তার অ্যাকাউন্টে।
তদন্ত কমিটি জানায়, গত পাঁচ বছরে প্রায় ২৫০–৩০০ ভুয়া শিক্ষার্থীর নামে টাকা তোলা হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় অর্ধকোটি টাকা।
প্রিন্সিপালের দায় এড়ানো কঠিন
মাদরাসার তদন্ত কমিটির মতে, কেরানি কামাল উদ্দিন সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও প্রিন্সিপালও নৈতিকভাবে দায়ী। ওটিপি ব্যবহার করে তিনিই অনুমোদন দিয়েছেন, অথচ হঠাৎ করে মাদরাসার টিউশন ফি দ্বিগুণ বা তারও বেশি হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি।
প্রিন্সিপাল দাবি করেছেন—তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তবে তদন্তকারীদের মতে, এমন অবস্থায় 'না জানার' অজুহাত দায় এড়ানোর উপায় হতে পারে না।
সাময়িক বহিষ্কার ও স্থানীয়দের ক্ষোভ
মাদরাসার তদন্ত কমিটির সুপারিশে কামাল উদ্দিনকে দুই মাসের জন্য সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় পরিদর্শক টিমের কাছে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—একজন অফিস সহকারী কীভাবে বছরের পর বছর এমন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি চালালেন, অথচ প্রতিষ্ঠানের প্রধান জানতেই পারলেন না?
শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যেখানে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর কথা, সেই বিদ্যাপীঠেই অন্ধকার দুর্নীতি গিলে খেল সরকারের কোটি কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, মাদরাসাটি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। এর একাডেমিক সুনাম বিবেচনায় নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে তদন্তে প্রকৃত অপরাধীর তথ্য প্রকাশ এবং কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।