‘ফ্রি ভিসা’ প্রতারণার শিকার হয়ে প্রবাসী কর্মীরা যেভাবে এক বছরেই ৩০ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন
অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীর কাছে অতি পরিচিত শব্দ তথাকথিত 'ফ্রি ভিসা'। তবে নামে 'ফ্রি' হলেও এটি আসলে মোটেও বিনামূল্যে পাওয়া যায় না।
'ফ্রি ভিসা' শব্দটি মূলত এমন একটি বৈধ নীতিকে বোঝায়, যেখানে অভিবাসী কর্মীদের আর্থিক বোঝা কমাতে নিয়োগকর্তা বা সরকার তাদের ভিসা ও বিমান ভাড়ার খরচ বহন করে। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসন খাতে এই ধারণাটি বিকৃত হয়ে গেছে।
বাস্তবে চাকরিপ্রত্যাশীরা এমন সব ভিসার জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেন, যেগুলোর সাথে কোনো নিশ্চিত কর্মসংস্থান বা বৈধ কাজের অনুমতির (ওয়ার্ক পারমিট) সম্পর্ক থাকে না।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) এক গবেষণা অনুসারে, বিদেশে সহজে চাকরি পাওয়ার প্রতিশ্রুতির আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রতারণা, অতিরিক্ত ফি ও শোষণের এক বিশাল জাল। এই শোষণের কারণে শুধু ২০২২ সালেই বাংলাদেশি কর্মীদের আনুমানিক ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ ওই বছর বাংলাদেশের মোট জিডিপির ০.৫৪ শতাংশের সমান।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় ভ্রমণ করা কর্মীদের গন্তব্য দেশে পৌঁছানোর পর ওয়ার্ক পারমিট বা আইনি বৈধতা পেতে প্রায়ই চাঁদা ও অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। নিয়োগ ফি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েও তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করা হয়।
এই ব্যয় মেটানোর জন্য অনেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। এতে তাদের দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর সক্ষমতা কমে যায়।
জরিপে অংশ নেওয়া প্রবাসীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ তথাকথিত 'ফ্রি ভিসা' প্রক্রিয়ায় গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলভুক্ত (জিসিসি) দেশগুলোতে গিয়েছিলেন।
তাদের মধ্যে ২১ শতাংশ প্রবাসীকে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর বৈধ অনুমতি পেতে গড়ে ১.৪৮ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এছাড়া চাকরি না পেয়ে নতুন চাকরি খুঁজতে বা দেশে ফিরে আসতে অন্যদের আরও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
ওকাপের গবেষণা অনুযায়ী, গন্তব্যে পৌঁছানোর পর কাগজপত্র বৈধ করতে যাদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে, তাদের অভিবাসনের গড় খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ৬৯৫ টাকা। আর যারা নিজেদের অবস্থান বৈধ করতে বাড়তি খরচ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের মোট খরচ বেড়ে ৭ লাখ ২২ হাজার ৪৫০ টাকায় পৌঁছেছে—যা তাদের বার্ষিক পারিবারিক আয়ের চেয়ে প্রায় ৬৭ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই 'ফ্রি ভিসা' ব্যবস্থাকে একটি অনিয়ন্ত্রিত ও শোষণমূলক প্রক্রিয়া, যা পুঁজি পাচারে ইন্ধন জোগানোর পাশাপাশি দেশের অভিবাসন অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলছে।
এই পদ্ধতিগত দুর্নীতি কীভাবে একাধারে কর্মীদের সঞ্চয় ও দেশের জাতীয় সম্পদ উভয়ই নিঃশেষ করে ফেলছে, তা উঠে এসেছে ওকাপের এই অনুসন্ধানে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় ১১.৩৫ লাখ কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ৯.৩৮ লাখ কর্মীই গিয়েছিলেন জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেও শোষণের শিকার বিদেশগামী কর্মীরা
ফ্রি ভিসা প্রতারণা ছাড়াও বিদেশ গমনেচ্ছু বাংলাদেশি কর্মীরা, বিশেষত উপসাগরীয় দেশ ও মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এখনও শোষণের শিকার হচ্ছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত মেডিকেল সেন্টারগুলো প্রায়ই অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। এমনকি পরীক্ষার পর ভুয়া রিপোর্ট ধরিয়ে দেওয়ার মতো অভিযোগও পাওয়া গেছে।
টিবিএসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের জন্য সরকারি নির্ধারিত মেডিকেল পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ফি প্রায় ১০ হাজার টাকা হলেও বেশিরভাগ কর্মীকে দ্বিগুণ বা তারও বেশি টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অযোগ্য হওয়া শ্রমিকদের যোগ্য হিসেবে সার্টিফিকেট নিতে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। প্রবাসী শ্রমিক ও খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এটি বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ।
স্বাস্থ্য পরীক্ষায় শোষণের মূল কারণ গালফ হেলথ কাউন্সিলের (জিএইচসি) অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারের সংখ্যা হুট করে বেড়ে যাওয়া।
বিদেশগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য প্রথমে এই মেডিকেল সেন্টারগুলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এরপর নিতে হয় জিএইচসির অনুমোদন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ গালফ মেডিকেল সেন্টারসের (বিএজিএমসি) তথ্যমতে, বাংলাদেশে জিএইচসি অনুমোদিত সেন্টারের সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল মাত্র ২৬টি। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২৬০টি। এই সংখ্যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। জিএইচসির অফিশিয়াল অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ওয়াফিদ-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১৬৭টি, পাকিস্তানে ১২৪টি, নেপালে ৩০টি এবং শ্রীলঙ্কায় ২৭টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে।
