সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে ৪৮ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি; সৌদি চুক্তিতে আরও উন্নতির আশা

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশিদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে সৌদি আরবের চাহিদা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি উপসাগরীয় দেশটির সঙ্গে হওয়া ঐতিহাসিক নিয়োগ চুক্তি এই সংখ্যাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, যা দেশের সংকুচিত শ্রম বাজারের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে সেপ্টেম্বরে প্রায় ৯৫ হাজার ৬৯৪ জন কর্মী বিদেশে গেছে। এই সংখ্যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হলেও আগস্টের চেয়ে ৩৩ শতাংশ কম। আগস্টে ১ লাখ ৪২ হাজার ৬৬৫ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন, যা ছিল এক মাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের রেকর্ড।
শ্রমশিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টের চেয়ে কম হলেও সেপ্টেম্বরের এই সংখ্যায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের স্বাভাবিক চিত্রই ফুটে উঠেছে।
গত কয়েক মাসের মতো সেপ্টেম্বরেও সবচেয়ে বেশি কর্মী নিয়োগ করেছে সৌদি আরব—৫৯ হাজার ৫০০ জন।
একটিমাত্র দেশের ওপর এই নির্ভরতা উদ্বেগ তৈরি করলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন, সোমবারের (৬ অক্টোবর) ঐতিহাসিক চুক্তির পর সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মীদের অধিকার সুরক্ষিত হবে। রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই চুক্তিটি দক্ষ অভিবাসনও বাড়াবে।
সৌদি আরব ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সাধারণ কর্মী নিয়োগ-সংক্রান্ত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই হলো। সৌদি আরবে ১৯৭৬ সাল থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। ২০১৫ সালে গৃহকর্মী নিয়োগ ও ২০২২ সালে দক্ষতা যাচাই-সংক্রান্ত দুটি বিশেষ চুক্তি সই হলেও দুই দেশের মধ্যে সাধারণ কর্মী নিয়োগ-সংক্রান্ত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল না।
বিএমইটির তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে বিদেশে পাঠানো প্রায় ৪৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মীর মধ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশ কর্মীই গেছেন সৌদি আরবে।
তবে এই বিপুলসংখ্যক কর্মীর অধিকাংশই মূলত স্বল্প-দক্ষ কাজে নিযুক্ত। ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মী এই ধরনের কাজে নিয়োজিত। এমনকি কর্মীদের একটি বড় অংশ প্রতিশ্রুত চাকরি পাননি অথবা অনিয়মিত বেতন ও ইকামা-সংক্রান্ত (বসবাসের অনুমতিপত্র) সমস্যায় ভুগছেন।
সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসি টিবিএসকে বলেন, 'সৌদি আরব এখন দক্ষ কর্মী নিয়োগের ওপর জোর দিয়েছে। কারণ অনেক স্বল্প দক্ষ কাজ এখন তাদের লোকেরাও করা শুরু করেছে। এ কারণে তারা বেশি দক্ষ কর্মী নিতে বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তি করছে।'
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর বাংলাদেশি সৌদি গেলেও তাদের অনেকে বেকার জানিয়ে তিনি বলেন, 'কথিত ফ্রি ভিসায় গিয়ে অনেকের কাজ নেই, অনেকে নিয়মিত বেতন পান না। আমাদের সময় প্রতিটি কর্মী আসার আগে চেক করতাম চাকরিটি জেনুইন কি-না। এটা দূতাবাসের দায়িত্ব।'
নতুন চুক্তির ফলে শ্রম অধিকার রক্ষিত হবে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'সব চুক্তিতেই ভালো ভালো কথা লেখা থাকে। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের দূতাবাসকে দায়িত্ব নিতে হবে।'
আন-অফিসিয়াল হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ৩২ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি সৌদি আরবে কাজ করছেন—যা দেশটিকে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য একক বৃহত্তম বিদেশি গন্তব্যে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এখনও সৌদি আরবে মূলত পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক ও গৃহকর্মী হিসেবে বেশিরভাগ কর্মী পাঠাচ্ছি। তাদের বেতন ৩০ হাজার টাকার বেশি নয়। কিন্তু আমরা যদি চুক্তি অনুযায়ী আরও দক্ষ কর্মী পাঠাতে পারি, তাহলে সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্সের ওপর এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের কর্মীদের একটি বড় অংশ মাসে ৬০০ থেকে ৮০০ সৌদি রিয়াল ন্যূনতম বেতন পাচ্ছেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এটি বাড়িয়ে ১ হাজার রিয়ালের বেশি করার জন্য আলোচনা করে আসছি। আশা করি, এই চুক্তির মাধ্যমে ন্যূনতম বেতন, ইকামা, নিয়মিত বেতন প্রদান এবং আমাদের কর্মীদের জন্য অন্যান্য সুরক্ষার বিষয়গুলোর সমাধান হবে।'
সৌদি আরব সম্প্রতি স্বল্প-দক্ষ কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক দক্ষতা যাচাই সনদ (এসভিপি—যা তাকামুল নামেও পরিচিত) চালু করেছে। এতে ভবিষ্যৎ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। তবে বাংলাদেশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ক্যাটাগরির জন্য এটি সাময়িকভাবে শিথিল করা হয়েছে।
অন্যান্য গন্তব্যে কর্মী নিয়োগের সংখ্যা ১ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে
সৌদি আরব ছাড়া অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী বাজারগুলোতে কর্মী নিয়োগ সীমিতই রয়েছে। সেপ্টেম্বরে শীর্ষ ১০ গন্তব্যের মধ্যে ছিল কাতার, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কম্বোডিয়া, জর্ডান, ইতালি ও ইরাক। তবে এসব দেশে কর্মী নিয়োগের সংখ্যা ছিল ১ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে।
মালয়েশিয়া, ওমান ও বাহরাইনের মতো ঐতিহ্যবাহী শ্রমবাজারগুলোতে কর্মী নিয়োগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৬০-৭০ হাজার কর্মী যেতে পারত, যা গত কয়েক বছরে প্রায় ১ লাখে উন্নীত হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে দেশে মোট ২.৬৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
চলতি অর্থবছরে এটি এখন পর্যন্ত এক মাসে আসা সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এর আগে জুলাইয়ে ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার ও আগস্টে ২.৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
রেমিট্যান্স প্রবাহে বার্ষিক প্রবৃদ্ধিও দেখা গেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২.৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে মার্চ মাসে, ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার।