স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়ার সুপারিশ থাকায় জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না সিপিবিসহ ৪ দল

জুলাই জাতীয় সনদে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং প্রক্লেমেশন বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তাই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগে সংশোধিত খসড়া না পেলে সনদে সই করবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে সিপিবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাম ধারার চারটি দল।
এসময় লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ।
এতে বলা হয়, 'সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ৬ষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা 'ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স' এবং ৭ম তফসিলে থাকা 'প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স' বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, তা বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। অথচ জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে; পটভূমিতে অভ্যুত্থান–পরবর্তী সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার কথা আগে পাঠানো খসড়া সনদে উল্লেখ থাকলেও চূড়ান্ত সনদে ১০৬ অনুচ্ছেদের কথা বাদ দেওয়া হয়েছে।'
বলা হয়, 'জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে সব দলের ঐকমত্য রয়েছে, শুধুমাত্র সেই বিষয়গুলোর স্বাক্ষর নেওয়া উচিত। ভিন্নমতগুলো আলাদা সংযুক্তি (এনেক্স) হিসেবে রাখা যেতে পারত।'
আরও বলা হয়, 'সনদের প্রথম অংশে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বারবার সংশোধনী দেওয়া হলেও তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।'
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, 'চূড়ান্ত অংশে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে বলা হয়েছে, কিন্তু ভিন্নমত থাকলে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার কীভাবে সম্ভব তা বোধগম্য নয়। অঙ্গীকারনামার দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হলেও, নোট অব ডিসেন্টসহ কীভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে তা স্পষ্ট নয়।'
বলা হয়, 'এছাড়া অঙ্গীকারনামার তৃতীয় ধারা, যেখানে বলা হয়েছে 'জুলাই সনদ নিয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না', তা নাগরিকের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী।'
আরও বলা হয়, 'আমরা শুরুতেই স্পষ্ট করে বলতে চাই—স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাদ দিয়ে কোনো ঐকমত্য সনদ আমরা গ্রহণ করব না। ঐক্যবদ্ধ কমিশনের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল, তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সনদের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, চূড়ান্ত খসড়ায় সেই অঙ্গীকার তারা রক্ষা করেনি। এই অবস্থায় আমরা ঘোষণা দিচ্ছি, সংশোধন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই আমরা সনদে স্বাক্ষর করব না।'
তবে তারা জোর দিয়ে বলেন, 'জুলাই সনদের যেসব বিষয়ে তারা একমত, সেসব বাস্তবায়নে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব বিষয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার তারা জাতির কাছে জানিয়েছেন।
বামজোটের নেতারা বলেন, 'সংবিধানে বিদ্যমান চার মূলনীতি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এবং ১৫০(২) অনুচ্ছেদের ক্রান্তিকালীন বিধানের তফসিল পরিবর্তনে সম্মতি প্রদান ও আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না এমন বিষয়ে অঙ্গীকার করতে হয়—এমন কোনো সনদে ভিন্নমত দিয়ে আমরা স্বাক্ষর করতে পারি না।'
এসব বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাদের পক্ষে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, 'আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্তও যদি সংশোধিত সনদ পাই, আমরা স্বাক্ষর করতে উপস্থিত হব।'
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বক্তারা বলেন, 'কমিশনের সঙ্গে আমাদের কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। শুধুমাত্র একটি নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে আমাদের উপস্থিতি আশা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, আলোচনা ও সর্বসম্মতি ছাড়া ঐক্য নয়, বিভাজনই সৃষ্টি হবে।'
তারা বলেন, 'আমরা আবারও বলছি—৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, ১০ এপ্রিলের প্রোক্লেমেশন এবং ১৬ ডিসেম্বরের স্বীকৃতি—এই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ইতিহাসকে উপেক্ষা করা মানে জাতির আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করা।'
বলা হয়, 'আমরা বিশ্বাস করি, ১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশের রাষ্ট্রচেতনার ভিত্তি। তাতে সংস্কার করা যেতে পারে, কিন্তু নতুন কোনো সংবিধানের নামে সেটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা যাবে না। নতুন সংবিধানের নামে ৭২-এর সংবিধানের কবর রচনা আমরা হতে দেব না।'
আরও বলা হয়, 'আমরা মনে করি, গণভোটের প্রস্তাব বিভ্রান্তিকর ও সংবিধানবিরোধী। কোনো সংসদ গণভোটের মাধ্যমে বাধ্য করা যায় না। বরং এটি রাজনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, দেশে অনির্বাচিত সরকারের দিন যত দীর্ঘ হবে, সংকট তত গভীর হবে। আমরা চাই, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক।'
বক্তারা বলেন, 'আজও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জামায়াত ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি সক্রিয় রয়েছে। আমরা তাদের প্রভাবমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ঐক্যবদ্ধ কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। তারা জানত আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করব না, তবু এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি একটি পরিকল্পিত বিভাজন ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।'
বলা হয়, 'আমরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী। তাই আমরা বলেছি, সর্বসম্মতি ছাড়া কোনো ঐক্য হতে পারে না। যদি কমিশন আমাদের প্রস্তাবিত সংশোধন গ্রহণ না করে, আমরা সনদে স্বাক্ষর করব না এবং প্রয়োজন হলে রাজপথে এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলব।'
এসময় সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সিপিবির সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, বাসদ (মার্কসবাদী)-এর সমন্বয়ক মাসুদ রানা এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ।