ডিসেম্বরে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত নয় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র: আইএমইডি

চলতি বছরের ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ইউনিট-১ বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। একইসঙ্গে এই কেন্দ্রের ইউনিট-২, নির্ধারিত ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে যেতে পারবে কিনা—তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট-১ এর পুনঃনির্ধারিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ডিসেম্বর ২০২৫-এ নির্ধারিত থাকলেও এ সময়ে উৎপাদন শুরু হচ্ছে না বলে প্রকল্প দপ্তর হতে জানা যায়। একইভাবে ইউনিট-২ এর পুনঃনির্ধারিত উৎপাদন ডিসেম্বর ২০২৬- এ শুরু করার জন্য নির্ধারিত থাকলেও তা সম্ভব হবে না বলে প্রতীয়মান হয়।
ইউনিট-১ ও ২ এর বিদ্যুৎ উৎপাদন কবে নাগাদ শুরু হবে এ বিষয়ক কোনও তথ্য প্রকল্প দপ্তর জানাতে পারেনি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে অসমাপ্ত কাজের তালিকাও দিতে পারেনি।
আইএমইডি প্রকল্প পরিচালককে রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট—রাশিয়ার রোসাটমের প্রকৌশল বিভাগ—এর সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে বলেছে, যাতে জনবল নিয়োগ ও সরঞ্জাম সংগ্রহের সময়সূচি স্পষ্ট থাকে।
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য প্রকল্প পরিচালক কবির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

১৯–২০ সেপ্টেম্বর কর্মকর্তাদের সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে আইএমইডির এই প্রতিবেদনটি ৮ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। পরিদর্শন দলে ছিলেন তৎকালীন আইএমইডি সচিব (বর্তমানে ধর্ম সচিব) কামাল উদ্দিন, পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও জ্বালানি বিভাগের সদস্য মোখলেস উর রহমান এবং আইএমইডির মহাপরিচালক ড. আল আমিন সরকার।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বরেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে। তিনি বলেন, 'আমরা নভেম্বরে চালু করার জন্য রাশিয়াকে চিঠি দিয়েছিলাম। তারা জানিয়েছে যে ডিসেম্বরে চালু করবে।'
উপদেষ্টা আরও বলেন, 'ইতোমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি চলে এসেছে। আইএইএ-এর একটা দল পর্যবেক্ষণ করে কিছু সুপারিশ করেছে। আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করছি। তারা আবার এসে ফাইনাল সম্মতি দেবে।'
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিং প্রক্রিয়া শুরু হয় জ্বালানি লোডিং থেকে, এর মধ্যে থাকে প্রথম ক্রিটিক্যালিটি ও পাওয়ার অ্যাসেনশন, এবং শেষে পূর্ণক্ষমতা পরীক্ষামূলক চালু, যার মাধ্যমে অপারেশনাল কার্যক্ষমতা যাচাই করা হয়।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আগামী ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক চালু করতে ফুয়েল লোডিং শুরু হবে। 'এরপর আগামী বছরের মার্চে প্রথম ইউনিট থেকে আংশিক বিদ্যুৎ পাওয়া হবে। সেক্ষেত্রে মার্চে ৩০ শতাংশের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। পরে পর্যায়ক্রমে উৎপাদন বাড়তে থাকবে, এবং ১০ মাসের মধ্যে প্রথম ইউনিট থেকে পুরো ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।'
সংশোধিত সময়সূচি
দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যেটির বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৬ সালে। এই প্রকল্পে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা ঋণ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরেই ঠিকাদার রুশ প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের সঙ্গে ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার চুক্তি হয়।
প্রাথমিক সময়সূচি অনুযায়ী ইউনিট–১ চালুর কথা ছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইউনিট–২। আর পুরো প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা ছিল ডিসেম্বর, ২০২৫। পরে সংশোধিত সময়সূচিতে ইউনিট–১ এর লক্ষ্য ঠিক করা হয় ডিসেম্বর ২০২৫, আর ইউনিট–২ এর ডিসেম্বর ২০২৬।
তবে কোভিড–১৯ মহামারি ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় রুশ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও পরিবহন বিলম্বিত হয়। বর্তমানে সময় বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৭ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রত্যেক ইউনিটের সক্ষমতা ১,২০০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ মোট ২,৪০০ মেগাওয়াট। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৭৩.৬২ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৭৪.২৪ শতাংশ। নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছে অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট।
আইএমইডির পর্যবেক্ষণে আর যা যা উঠে এল
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনিট–১ এর সিভিল কাঠামো ও সাধারণ সুবিধার নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে। রিঅ্যাক্টর ভবনের সিভিল ওয়ার্ক সম্পন্ন হয়েছে ৯৮ শতাংশ, আর সরঞ্জাম স্থাপন হয়েছে ৯৫ শতাংশ। কন্টেইনমেন্ট এলাকার দৃঢ়তা ও লিক–টাইটনেস টেস্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
অক্সিলিয়ারি রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের নির্মাণ ৯৮ শতাংশ এবং যন্ত্রপাতি স্থাপন কাজ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। টারবাইন ভবনের ভৌত নির্মাণ কাজ ৯৮ শতাংশ এবং যন্ত্রপাতি স্থাপন কাজ ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
একইভাবে, ইউনিট–২ ও এর সাধারণ স্থাপনার নির্মাণও শেষ পর্যায়ে। ইউনিট–২ রিঅ্যাক্টর ভবনের সিভিল ওয়ার্ক ৯৩ শতাংশ, যন্ত্রপাতি স্থাপন ৮২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি অক্সিলিয়ারি রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের নির্মাণ ৮৫ শতাংশ, এবং যন্ত্রপাতি স্থাপন কাজ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
চুক্তির শর্তানুসারে, ইউনিট-২ এর বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ইউনিট-১ হতে এক বছর পর নির্ধারণ করা হয়েছে।
৪টি কুলিং টাওয়ারের সবকয়টির ভৌত নির্মাণকাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। মোট ১৩৩টি প্রধান কাঠামো — যেমন ফ্রেশ ফুয়েল স্টোরেজ, হেলথ ফিজিক্স বিল্ডিং, ফায়ার স্টেশন ইত্যাদির সিভিল নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
রাশিয়ার সরবরাহকৃত পারমাণবিক জ্বালানি নির্ধারিত ভবনে সংরক্ষিত রয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন জানায়, আইএইএ'র নির্দেশনা অনুযায়ী ইউনিট–১ এর কমিশনিং কাজ ধাপে ধাপে চলছে, যা এখন জ্বালানি লোডিং বা ফিজিক্যাল স্টার্টআপ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কন্টেইনমেন্ট টেস্টিং—যা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ধাপ—ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এই পরীক্ষা কাঠামোর দৃঢ়তা যাচাই করে। কোথাও যদি লিকেজ, ফাটল বা দুর্বলতা থাকে—তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়, ভবিষ্যতে কোনো বিকিরণ বাইরে ছড়ানোর ঝুঁকি থাকবে না।
সে আলোকে এ৩.১ এবং এ৩.২ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কার্যক্রম যেমন কোল্ড রানিং এবং হট রানিং টেস্ট কার্যাদি সম্পাদন করার জন্য এ পরীক্ষা চালানো হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি ভরার পূর্বে এ জাতীয় পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে টারবাইন যন্ত্রপাতির নির্ভরযোগ্যতা ও নিরাপদ কার্যক্রম নিশ্চিত করা হয়।
বর্তমানে ইউনিট–১ এ এই হট ও কোল্ড টেস্ট চলছে, এবং কয়েকটি সাব-স্টেজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী এ৪ পর্যায়ে রিঅ্যাক্টরের মূল যন্ত্রপাতি পরিদর্শন ও জ্বালানি লোডিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হবে।
তবে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা তদারকি–সংক্রান্ত কয়েকটি সহায়ক প্রকল্প পিছিয়ে রয়েছে—যেমন অফসাইট পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভৌত নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন, এবং এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক গঠন।
মূল প্রকল্পের সাথে নিবিড়ভাবে সমন্বয় করে এ প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রাশান ফেডারেশনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট -এর সাথে চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার নিমিত্ত লেভেল-২ শিডিউল প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও ডিসেম্বর ২০২২ এর পর উক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বার্ষিক এই সময়সূচিটি প্রদান করেনি। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে সমাপ্তি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হতে এটি নেওয়া প্রয়োজন বলে আইএমইডি উল্লেখ করেছে।