ইউরোপ–আফ্রিকার ক্রুডও পরিশোধন করতে পারবে ইস্টার্ন রিফাইনারি
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন উৎসের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) পরিশোধনের সুযোগ রেখে তৈরি করা হবে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২)। এর মাধ্যমে ক্রুড আমদানিতে সরকারের মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক নির্ভরতা কমবে। এছাড়াও প্রাথমিক ব্যয় প্রস্তাব থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৩৫ হাজার ৪৬৫.১৫ কোটি টাকায় প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেয়েছে।
গতকাল বুধবার পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায়, কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য ড. মোখলেস উর রহমান প্রস্তাবিত "ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ" প্রকল্পটি প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
পিইসি সভাশেষে জ্বালানি বিভাগের সচিব মো. সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, প্রকল্পে এরাবিয়ান লাইট ক্রুড (এএলসি) ও মারবান ক্রুডকে ফিডস্টক হিসেবে ধরে বেসিক ডিজাইন সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে রাশিয়া, নরওয়ে, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত ক্রুড পরিশোধনের ব্যবস্থাও রাখা হবে।
তিনি আরো জানান, ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটে রাশিয়ার উরাল ক্রুড বা নাইজেরিয়ার ব্রাস রিভার ক্রুডের মধ্যে জ্বালানি আলাদাভাবে বয়েল করে (ফুটিয়ে) রিফাইনারিতে পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখা রয়েছে। এইভাবে দ্বিতীয় ইউনিটের ডিজাইন করা হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, পাশাপাশি ভারী ক্রুড পরিশোধনের লক্ষ্যে ক্রুড ব্লেন্ডিং (মিশ্রণ) সুবিধা রাখা হবে দ্বিতীয় ইউনিটে। এ জন্য প্রস্তাবিত দ্বিতীয় ইউনিটে বিভিন্ন দেশের হেভি ক্রুড পরিশোধন উপযোগী "ফ্লেক্সিবল সিস্টেম" নিশ্চিত করা হবে।
প্রকল্পের ব্যয় কমানোর প্রসঙ্গে জ্বালানি সচিব বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় সব খাত বাদ দেওয়ার মাধ্যমে প্রকল্প খরচ কমানো হয়েছে।
কোন কোন খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, গাড়ি কেনা, আপ্যায়ন ব্যয়ের মতো অগুরুত্বপূর্ণ সব ধরনের ব্যয় বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দরকারি অঙ্গেও ব্যয় যতটুকু না করলেই নয়, কেবল সেটুকু রেখে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ায় বর্তমান সরকার শেষপর্যন্ত ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) সরকারি তহবিলের মাধ্যমে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত পর প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৪২ হাজার ৯৭৩.৭০ কোটি টাকা, যা শেষপর্যন্ত ৩৫ হাজার ৪৬৫.১৫ কোটি টাকায় নেমেছে। এই ব্যয়ের ২১ হাজার ২৭৭.৫৯ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হবে। এবং বাকি ১৪ হাজার ১৮৭.৫৬ কোটি টাকা ইস্টার্ন রিফাইনারি কোম্পানির তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আমদানি-নির্ভর পেট্রোলিয়াম পণ্যের উপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে, কারণ দেশের মোট পরিশোধন সক্ষমতা বেড়ে বছরে ৪৫ লাখ টনে পৌঁছাবে।
দীর্ঘদিনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি অর্থ সংকটে
২০১০ সালে ইআরএল-২ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং ২০১৩ সালে সরকার প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন করে। কিন্তু প্রকল্পটি কোনো অগ্রগতি পায়নি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) স্ব-অর্থায়নে নতুনভাবে উদ্যোগ নিলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার কোটি টাকায়, তবু কাজ শুরু হয়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও অর্থায়ন সংক্রান্ত জটিলতায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
২০২৪ সালের শুরুতে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইআরএল-২ নির্মাণের আগ্রহ দেখালে ৯ জুলাই জ্বালানি বিভাগ প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। কিন্তু, গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটায় প্রকল্পটি স্থগিত রাখা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসে নতুন করে প্রকল্পটি সচল করার উদ্যোগ নেয়, এবং প্রথমে বিদেশি ঋণে বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়।
তবে বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত করতে না পারায় এখন সরকারি ও এবং বিপিসির নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৪২ হাজার ৯৭৩.৭০ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারি তহবিলে ৩০ হাজার ৪৯৯.৮০ কোটি টাকা এবং ১২ হাজার ৪৭৩.৯০ কোটি টাকা বিপিসির তহবিল থেকে ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে পরিকল্পনা কমিশন যাচাই-বাছাই শেষে প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে আনে।
বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার সংগঠন- ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ইআরএল–২ প্রকল্প সরকারি মালিকানায় বাস্তবায়ন করা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। আগের সরকার যখন এটি বেসরকারি খাতে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, তখনই ক্যাব সতর্ক করেছিল—বিদেশি বা বেসরকারি অর্থায়নে গেলে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে, জ্বালানির দাম বাড়বে এবং দুর্নীতি বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। তাই সরকারিভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তকে ক্যাব স্বাগত জানায়।
তিনি আরও বলেন, টেন্ডার ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে এটি হবে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। আর যারা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্প বিলম্বিত করেছে ও ব্যয় বাড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
