ওএমএসে সরবরাহ ও মজুত ঠিক রাখতে জরুরিভাবে ৪ লাখ টন চাল আমদানি করছে সরকার

উত্তরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত ও ডিসেম্বরের আগে নতুন ধান ওঠার সুযোগ না থাকায় নিরাপদ খাদ্য মজুত ধরে রাখা ও খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি সচল রাখার পাশাপাশি বাজারে চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে জরুরিভাবে ৪ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, খোলা বাজারে (ওএমএস) চালের বিতরণ প্রায় ৫০ হাজার টন কমানো হয়েছে। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দ্রুত আমদানি করার জন্য দরপত্র প্রক্রিয়ার সময়সীমা ২৭ দিন কমানো করা হয়েছে।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর দর দাখিলের জন্য ৪২ দিন সময় দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সময়সীমা কমিয়ে ১৫ দিন নির্ধারণে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা সচল করা, চালের বাজারমূল্য ভোক্তা সাধারণের জন্য সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে এসব চাল আমদানি করা হবে।
খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান টিবিএসকে বলেন, ১৩.৫০ লাখ টনকে নিরাপদ মজুত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পরিমাণ মজুত ধরে রাখা সরকারের লক্ষ্য।
'ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত দেশে নতুন ধান ওঠার সুযোগ নেই। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে যাতে দেশের মানুষ কষ্টের সম্মুখীন না হয়, সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানি করা হচ্ছে,' বলেন তিনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জরুরিভাবে ৪ লাখ টন আমদানি উদ্যোগে আওতায় ভারত থেকে ৫০ হাজার টন আমদানির দরপত্র শেষ হয়েছে।
ভারতের রায়পুরের এম/এস বাগাদিয়া ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড ৩৫৯.৭৭ ডলারে প্রতি টন চাল সরবরাহ করবে। আরও ৫০ হাজার টনের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বাকি ৩ লাখ টন আমদানির দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়ায় আছে।
খাদ্য সচিব বলেন, নভেম্বরের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে এসব চাল আমদানি সম্পন্ন হবে। তবে পুরো ৪ লাখ টন আমদানির প্রয়োজন না-ও হতে পারে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভা হবে। ওই সময় আমন মৌসুমের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কবে থেকে শুরু হবে, সেটি নির্ধারণ করা হবে।
এএমএসে কমেছে বিতরণ
খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান জানান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে নতুন ৫ লাখ পরিবারকে সুবিধাভোগী হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। টিসিবির কার্ডের সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে।
এছাড়া ৪৯৫ উপজেলায় ওএমএস চালু করা হয়েছে। এসব কারণে সরকারের চালের সরবরাহ বাড়াতে হচ্ছে। এছাড়া ঐতিহাসিকভাবে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাজারে চালসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা থাকে। তাই চাল আমদানির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখাও সরকারের লক্ষ্য।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসুচি, ভিজিডি, জিআর, ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় সরকার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনসাধারণকে কম দামে চাল ও গম দিয়ে থাকে।
এসব খাদ্য সহায়তা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা পরিবার সরকারের ইস্যু করা কার্ডের বিপরীতে পেয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন বাহিনী ও দপ্তর, অধিদপ্তরের কর্মীদের জন্য রয়েছে রেশন সুবিধা।
এর বাইরে সর্বসাধারণের সহায়তার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই কার্যক্রমের আওতায় যেকোনো ব্যক্তি একবারে ৩০ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল ও ২৭ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ ৫ কেজি আটা কিনতে পারেন।
ভ্রাম্যমান ট্রাক বা নির্দিষ্ট ডিলারদের মাধ্যমে এ কার্যক্রম পরিচালনা করে খাদ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওএমএসের মাধ্যমে ১ লাখ ৪২ হাজার ২৬৪ টন চাল ও ১ লাখ ২০ হাজার ৬৮২ টন আটা—অর্থাৎ মোট ২ লাখ ৬২ হাজার ৯৪৬ টন খাদ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে সরকার।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের একইসময়ে ওএমএসের মাধ্যমে ১ লাখ ৯৪ হাজার ২০৬ টন চাল ও ৯৮ হাজার ৪২৮ টন গমসহ মোট ২ লাখ ৯২ হাজার ৬৩৪ টন খাদ্য বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে।
এ হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ২৯ হাজার ৬৮৮ টন খাদ্য বিতরণ কম করা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য মজুত ধরে রাখতেই ওএমএসে খাদ্য বিতরণ কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এছাড়া এ বছর চালের বিতরণ কমেছে ৪৯ হাজার ৯৪২ টন। তবে এই সময়ে আটা বা গমের বিতরণ বেড়েছে ২২ হাজার ২৫৪ টন।
দেশের মানুষ আটার তুলনায় চাল বা ভাত খেতে পছন্দ করলেও চালের মজুত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ধরে রাখতে আটা সরবরাহ বাড়াতে হয়েছে খাদ্য অধিপ্তরকে।
খাদ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, সরকার নিরাপদ মজুত ধরে রাখতে ওএমএসে বিতরণ কমিয়েছে।
তবে সম্প্রতি বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ওএমএসের লাইনে ক্রেতা বেড়েছে। 'অধিকাংশ দিনই ওএমএসের ট্রাক বা দোকানে লাইনে দাঁড়ানো সব ক্রেতাকে চাল বা আটা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ক্রেতা দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন,' বলেন তিনি।
বাড়ছে চালের দাম
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে স্বর্ণার মতো মোটা জাতের প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা দরে, যা একবছর আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। এছাড়া পায়জামসহ মাঝারি মানের চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা দরে, যা এক বছর আগে ছিল ৫৫-৬০ টাকা। আর নাজিরশাইলসহ সরু জাতের চালের দাম এখন ৭২-৮৫ টাকা; একবছর আগে যা ছিল ৬৪-৮০ টাকা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চালসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ সময় বাজারে নতুন কোনো ধানের সরবরাহ থাকে না, আবার পরিবহনও খরচ বাড়ে।
তারা আরও বলেন, টানা বৃষ্টি বা অতিবৃষ্টির কারণে কোনো কোনো সময় সরবরাহ ব্যাহত হয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বেশি সময় ধরে বৃষ্টি হয়েছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেশি। এতে চাল, শাকসবজি, মসলার বাজারে পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে; দামও বেড়েছে।
আমদানি ও মজুত
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারের কাছে ১৫ লাখ ৬৬ হাজার ২৮৩ টন চাল, ৬০ হাজার ২০৪ টন গম ও ৬ হাজার ৮৩ টন ধান মজুত রয়েছে।
ধান ও গমকে চালে রূপান্তর করা হলে সরকারের কাছে মজুতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৪৪১ টন। যদিও গত ২০ আগস্ট সরকারের মজুতের পরিমাণ ছিল ২২ লাখ ৪ হাজার ৪৭৮ টন। ৫০ দিনের ব্যবধানে সরকারের খাদ্যের মজুত কমেছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৩৭ টন।
চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয় ৫০ হাজার ৪৩ টন চাল আমদানি করেছে। এ অর্থবছরে সরকার মোট ৯ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। এজন্য বাজেটে ৫৪৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ৮ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল আমদানি করেছিল।