লক্ষ্মীপুরে ধান চাষে ১০–১৪ বার কীটনাশক প্রয়োগ, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। অথচ সেই ভাতের জোগান দিতে গিয়ে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের কৃষকরা জড়িয়ে পড়েছেন ভয়াবহ এক 'বিষচক্রের' জালে। ধান উৎপাদনে কৃষকদের এখন ১০ থেকে ১৪ বার পর্যন্ত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। মাত্র পাঁচ বছর আগেও যেখানে ৫–৭ বার স্প্রে করলেই ফসল ঘরে তোলা যেত, সেখানে এখন তার দ্বিগুণ বিষ প্রয়োগেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফল।
অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় এবং নকল কীটনাশকের অবাধ বিস্তারে ধানচাষ এখন পরিণত হয়েছে 'বিষনির্ভর' কৃষিতে। এতে একদিকে যেমন কৃষকরা আর্থিকভাবে পঙ্গু হচ্ছেন, অন্যদিকে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে দেশের সাধারণ মানুষ। তবুও বিষ বিক্রেতা, আমদানিকারক কিংবা উৎপাদনকারী; কারও ওপরই নেই কার্যকর নজরদারি।
গত নভেম্বর থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ১০টি গ্রাম ঘুরে এবং অন্তত ৩০-৪০ জন কৃষক, কীটনাশক ব্যবসায়ী, কৃষি কর্মকর্তা ও রাসায়নিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
১০-১৪ দফার বিষ প্রয়োগের পর ঘরে আসছে ধান
লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে চর উভূতি গ্রাম। ওই গ্রামের কৃষক আবদুল হাকিম এ মৌসুমে ৩ একর জমিতে ধান চাষ করেছেন। ধান কাটার মাত্র দুই দিন আগে তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তখনো তিনি ধানের শীষ বাঁচাতে শেষবারের মতো কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন।
হতাশ কণ্ঠে আবদুল হাকিম বলেন, 'মোট ১৪ বার স্প্রে করেছি। এর মধ্যে ৯ বার কীটনাশক ও ৫ বার ছত্রাকনাশক। এসব না দিলে ধানই ঘরে তুলতে পারতাম না।'
একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামের কৃষক মো. ইসমাইল, মফিজ ও শাহ আলম। তারা জানান, বীজতলা তৈরির সময় থেকেই শুরু হয় এই 'স্প্রের যাত্রা'। চারাগাছ রোপণ থেকে ধান পাকা পর্যন্ত মোট ১০–১৪ বার স্প্রে করতে হচ্ছে। ফসলের কোনো সমস্যা দেখা দিলেই তারা দোকানে ছোটেন, আর দোকানদার যা দেন, তা-ই ক্ষেতে প্রয়োগ করেন। কাজ না হলে আবার নতুন বিষ দেন।
এই তিন কৃষকের ভাষ্যমতে, চলতি মৌসুমে বীজতলায় প্রথমবার এবং এরপর ৮ দিন, ২০-২৫ দিন ও চারা তোলার আগে মিলিয়ে মোট ৪ বার স্প্রে করা হয়। চারা রোপণের পর থোড় আসার আগ পর্যন্ত ৩ বার, থোড় থেকে ধান বের হওয়া পর্যন্ত ৩ বার এবং কাটার আগে ১–৪ বার পর্যন্ত স্প্রে করেছেন তারা। তাদের আক্ষেপ, 'আমরা ধান চাই, কিন্তু এখন প্রচুর বিষ ছাড়া ধান হয় না। বাজারের বেশির ভাগ বিষেই কাজ হয় না, সব নকল। এতে বিক্রেতার লাভ হলেও আমাদের শুধুই ক্ষতি।'
নকল বিষের রমরমা বাণিজ্য
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ৬৩০ জন খুচরা ও ৬৭ জন পাইকারি মিলিয়ে মোট ৭০০ কীটনাশক বিক্রেতা রয়েছেন। তবে সরেজমিনে জানা গেছে, এই বিক্রেতাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত এবং রাসায়নিক সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম ধারণা নেই। মূলত তাদের পরামর্শেই কৃষকরা বিষচক্রে আটকা পড়েছেন।
চর উভূতি গ্রামের শিক্ষিত ও সচেতন কৃষক মালেক ও কবির উদ্দিন জানান, বাজারে প্রায় ২০০ কোম্পানির হাজারো বিক্রয় প্রতিনিধি সক্রিয়। ফলে মৌসুমে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের বাণিজ্য রমরমা হয়ে ওঠে। অশিক্ষিত বিক্রেতারা বিষের প্রতিক্রিয়া না বুঝেই কৃষকের হাতে রংবেরঙের প্যাকেট ধরিয়ে দিচ্ছেন।
কৃষক জাহের ও জসিম বলেন, 'আমরা নিজেরাও বুঝি বাজারে নকল ওষুধ। কিন্তু আমাদের তো ল্যাবরেটরি নেই যে পরীক্ষা করব। দোকানদার যা দেয়, তা-ই বিশ্বাস করে আনি।'
উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামের কীটনাশক বিক্রেতা আনোয়ার জানান, বাজারে মাত্র ৫–১০টি কোম্পানির ওষুধ মানসম্মত, যাতে বিক্রেতার লাভ থাকে মাত্র ১০–১৫শতাংশ। এর বিপরীতে ২০০টিরও বেশি নিম্নমানের কোম্পানির ওষুধে কমিশন থাকে ৪০–৫০শতাংশ। তাই অধিক লাভের আশায় বিক্রেতারা নিম্নমানের ও নকল বিষই কৃষকের হাতে তুলে দেন। আনোয়ার আরও বলেন, 'গত ১০ বছরে একদিনও মাঠে কোনো মনিটরিং হতে দেখিনি।'
'বিষ' বিক্রির নেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা বা নীতিমালা
চর মার্টিন গ্রামের কীটনাশক বিক্রেতা মোরশেদ আলম ১০ বছর কীটনাশক কোম্পানিতে কাজ করেছেন। তিনি এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, 'বাজারের ৮০শতাংশ কীটনাশকই নিম্নমানের। ৫০০ টাকা দিলেই কৃষি বিভাগ যে কাউকে কীটনাশকের লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার কোনো বালাই নেই। ফলে যারা রাসায়নিক বোঝে না, তারাই কৃষকের হাতে অপ্রয়োজনীয় বিষ তুলে দিচ্ছে।'
তিনি জানান, ৫০ টাকা মানের একটি নিম্নমানের ওষুধের প্যাকেটে গায়ের মূল্য লেখা থাকে ৫০০ টাকা। এতে কোম্পানি ও বিক্রেতা—উভয়েই বিপুল মুনাফা করে। এই অতিরিক্ত লাভের লোভেই কৃষকদের বারবার স্প্রে করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্বীকার করেন, 'কীটনাশক বিক্রিতে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বাধ্যবাধকতা বা নীতিমালা নেই। যে কেউ চাইলেই লাইসেন্স পেতে পারেন।'
নকল বা নিম্নমানের কীটনাশক মনিটরিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
কীটনাশক ও খরচের খতিয়ান
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের কৃষকরা পোকা দমনে সায়াবেথিন, সাইপারমেথ্রিন, ল্যাম্বডা সাইহ্যালোথ্রিন, মেলাথিয়ন, এমামেকটিন বেনজয়েট, ইমিডাক্লোপ্রিড, থায়ামেথোক্সাম, ক্লোরোপাইরিফস ও এসিটামিপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করছেন। ভাইরাসে ম্যানকোজেব, অ্যাজোক্সিস্ট্রোবিন, কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক এবং নানা হরমোন ও রাসায়নিক সারও দেদারসে ব্যবহার হচ্ছে।
ব্যবসায়ী আবদুল মাজেদ ও মোরশেদ আলমের হিসেবে, এক বিঘা জমিতে বর্তমানে ভালো মানের কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলেও খরচ হয় কয়েক হাজার টাকা। মাজরা পোকার জন্য ৫ বার স্প্রেতে খরচ প্রায় ১৭৫০ টাকা, ৩ বার ছত্রাকনাশকে ১২০০ টাকা এবং বাদামী গাছ ফড়িংয়ের জন্য ৭০০ টাকা। সব মিলিয়ে বিঘা প্রতি খরচ প্রায় ৪০০০ টাকার কাছাকাছি। তবে নিম্নমানের ওষুধের কারণে কৃষকদের বাস্তবে এর চেয়ে ৪-৫ বার বেশি স্প্রে করতে হচ্ছে, যা খরচ ও বিষের মাত্রা; উভয়ই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত: ভাতের পাতে বিষের ঝুঁকি
ধান উৎপাদনে এই লাগামহীন কীটনাশক প্রয়োগ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নেয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর বলেন, 'ধান উৎপাদনে ১০–১৪ বার কীটনাশক প্রয়োগ একটি বিপজ্জনক মাত্রা। প্রতিটি রাসায়নিকের একটি লাইফসাইকেল থাকে। অতিরিক্ত প্রয়োগকৃত এই বিষ ধানের চালে অবশিষ্ট হিসেবে থেকে যাবে। এটি মানুষের শরীরে স্নায়বিক ক্ষতি, হরমোনগত সমস্যা, প্রজনন অক্ষমতা ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াবে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, সঠিক তদারকি না হলে ভবিষ্যতে ভাত খাওয়াই মানুষের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবীর জানান, চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরীক্ষা ছাড়াই নিম্নমানের সার ও কীটনাশক আমদানি হচ্ছে। এতে সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতু ও তেজস্ক্রিয় উপাদান পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, 'জাতীয় খাদ্যদূষণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত নভেম্বরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠি দিয়েছি, যেখানে খাদ্যে কীটনাশকের বেপরোয়া ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষক স্প্রে করার পরপরই ফসল বাজারে তোলায় কীটনাশকের অবশিষ্ট সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে।'
