৪৯ বছরের ঐতিহ্য: দুর্গাপূজায় খুলনার কুড়ুলিয়া নদীতে নৌকা বাইচ উৎসব

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা ইউনিয়নে দুর্গাপূজার নবমী তিথি এলেই যেন প্রাণ ফিরে পায় শান্ত কুড়ুলিয়া নদী। দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে এই দিনে এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। প্রায় অর্ধশতাব্দীর এই আয়োজন এখন আর শুধু একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়, এটি পরিণত হয়েছে স্থানীয় মানুষের মিলনমেলা, গ্রামীণ সংস্কৃতির ধারক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য প্রতীকে।
প্রতি বছরের মতো এবারও বুধবার বিকেলে ইউনিয়নের আম্মুর কাঁটা গ্রামে কুড়ুলিয়া নদীতে এই নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। এবারের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তিনটি নৌকা। দুপুর গড়াতেই নদীর দুই পাড়ে ভিড় জমতে শুরু করে, যা সন্ধ্যা নাগাদ প্রায় ৩০ হাজার দর্শনার্থীর সমাগমে রূপ নেয়। নারী, পুরুষ ও শিশুদের সম্মিলিত উল্লাসে এবং ঢাকঢোলের শব্দে পুরো এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো দর্শক বাঁশি বাজিয়ে ও চিৎকার করে মাঝিদের উৎসাহ জোগান। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নৌকার মাঝিরাও সমস্বরে গান ধরে দর্শকদের মুগ্ধ করেন, যা এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ।
এই আয়োজনকে শুধু পূজা উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করার লক্ষ্যেই নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয় বলে জানান আয়োজকরা।
সোলাদানা ইউনিয়ন দুর্গাপূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সমিরন কুমার মণ্ডল বলেন, 'আমরা শুধু পূজা উদযাপন করি না, বরং এ উৎসবকে ঘিরে সব ধর্মের মানুষকে একত্র করতে চাই। নৌকা বাইচের মাধ্যমে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান সবাই মিলিত হয়, আনন্দ ভাগাভাগি করে। পূজার মণ্ডপে যারা আসতে চান না, তারাও যেন আমাদের উৎসবে অংশ নিতে পারেন, সেজন্যই এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। এভাবেই ৪৯ বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে সোলাদানা।'

কমিটির উপদেষ্টা এস এম এনামুল হক বলেন, 'প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে দুর্গাপূজার নবমীতে নৌকা বাইচ আমাদের এলাকায় একটি আনন্দঘন আয়োজন। এটি শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও মিলনের প্রতীক। নতুন প্রজন্মকে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোও এর বড় লক্ষ্য।'
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া মাঝি থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক—সবার কাছেই এই দিনটি বিশেষ আবেগের। নৌকার মাঝি আব্দুল জলিল বলেন, 'আমরা সারা বছর এই দিনের জন্য অপেক্ষা করি। শুধু জয়-পরাজয় নয়, গ্রামের মানুষের সামনে শক্তি ও দক্ষতা দেখানোর আনন্দটাই সবচেয়ে বড়।'
এলাকার বাসিন্দা খোকন মল্লিক জানান, 'শৈশব থেকে নৌকা বাইচ দেখে আসছি। এখনো যখন ঢাকঢোলের শব্দে নদীতে নৌকা নামে, মনে হয় গ্রামের পুরোনো দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে।'
প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে গ্রামের কয়েকজন সংস্কৃতিমনা মানুষ দুর্গাপূজা
উপলক্ষে প্রথম এই নৌকা বাইচের আয়োজন করেছিলেন। সেবার মাত্র দুটি নৌকা অংশ নিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকায় এটি এখন সোলাদানার সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
নৌকা বাইচ ঘিরে নদীর পাড়ে একটি অস্থায়ী মেলাও বসে। সেখানে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের খাবার, খেলনা, পোশাক এবং হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেন, যা উৎসবের আমেজকে আরও বাড়িয়ে তোলে।