হাসপাতালের বিছানায়ও আ.লীগের এমপি নূরুল মজিদের হাতে হাতকড়া, মানবাধিকারকর্মীদের নিন্দা

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের মৃত্যুর পর দুটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবি দুটিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি (নূরুল মজিদ) হাতকড়া পরা অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রয়েছেন। তার চোখ বন্ধ।
অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসনের সাবেক এমপি। তিনি এই আসনে পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন।
কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, এটি নূরুল মজিদকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর প্রথমদিকে তোলা ছবি। আর ছবিটি তোলা হয়েছিল যখন তিনি আইসিইউ-তে ছিলেন।
আর আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, কারাবন্দি নূরুল মজিদের ওই ছবি মৃত্যুর আগের হোক বা পরের, তাকে এভাবে হাতকড়া পরানো সরাসরি সংবিধান ও হাইকোর্টের রায়ের লঙ্ঘন।
তারা আরও বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ ঘটনা যথাযথ তদন্ত করে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন, যাতে করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, একজন মৃত্যুপথযাত্রী ও পরবর্তীতে মৃত মানুষের হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাখা অমানবিক। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৮ সালে একটি হাইকোর্ট বেঞ্চের রায়ে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের হাতকড়া পরানোর ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহার করা যাবে না। একইসঙ্গে এ বিষয়ে (হাতকড়া পরানো) সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
পুলিশ প্রবিধান বা পিআরবির ৩৩০ ধারার বলা হয়েছে, বিচার বা আসামির পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে পুলিশকে প্রয়োজনের বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত নয়। হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার প্রায়শই অপ্রয়োজনীয় অসম্মানজনক। কোনো অবস্থাতেই নারীদের হাতকড়া পরানো যাবে না; এবং যাদের বয়স বা দুর্বলতার কারণে সহজেই এবং নিরাপদে হেফাজতে রাখা যায়, তাদের ক্ষেত্রেও এসব ব্যবহার করা যাবে না।
ব্লাস্টের পক্ষে ওই রিট মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী আবু ওবায়দুর রহমান। তিনি গতকাল বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদের যে ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, এটি দেখে বলার অপেক্ষা রাখে না, এক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন হয়েছে। একজন ৭৫ ঊর্ধ্ব বয়স্ক মানুষ কীভাবে দুর্ধর্ষ বা পালানোর সম্ভাবনা থাকা আসামি হিসেবে গণ্য হবে, এটার কি কোনো ব্যাখা আছে? এছাড়াও পিআরবিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অসুস্থ কোনো বন্দিকেও হাতকড়া পরানো যাবে না।
মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফাইজুল কবির কারা আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বলেন, 'আমাদের দেশের ১৮৯৪ সালের যে কারা আইন রয়েছে, তা সংস্কার করা জরুরি। এখনো রাষ্ট্র শত বছরেরও পুরনো এই আইনের অধীনেই চলছে। কোনো বন্দিকে অযথা হাতকড়া বা পায়ে বেড়ি পরানো উচিত নয়। এগুলো অবশ্যই বাতিল করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলগুলোতেও (ইউডিএইচআর, অনুচ্ছেদ ৫; আইসিসিপিআর, অনুচ্ছেদ ১০) অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধের বিষয়ে বলা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'একজন ৮০ বছরের বৃদ্ধ, গুরুতর অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী, যিনি দেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সাবেক মন্ত্রী, তার সঙ্গে এমন আচরণ করা কেবল মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী নয়, এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে মারাত্মক ব্যর্থতারও প্রমাণও।'
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়ে নাগরিকদের সমান অধিকার দিয়েছে উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া এ ঘটনাকে সংবিধানের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, আইন প্রয়োগের সময় খেয়াল রাখতে হয় তা যেন সিলেক্টিভ না হয়ে পড়ে। আইন সবার জন্য সমান- এই মৌলিক অধিকার কেবল কথার কথা নয়, এটি সত্যিকার অর্থে করে দেখাতে হয়। একজন বয়স্ক, অসুস্থ ব্যক্তির সাথে এভাবে আচরণ করা কর্তৃত্ববাদী অনুশীলনের ধারাবাহিকতাকে প্রতিফলিত করে।
কারা কর্তৃপক্ষ যা বলছে
কারা অধিদপ্তর বলছে, ছবিটি আইসিইউ-তে তোলা হয়েছিল। তাদের দাবি, ছবিটি সাবেক এই এমপিকে হাসপাতালে ভর্তির করার প্রথমদিকে তোলা।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও উন্নয়ন) জান্নাত-উল-ফরহাদ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের একটি ছবি ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কারা কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ছবিটি কোনোভাবেই তার আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থার নয়। সবার প্রতি অনুরোধ– দায়িত্বশীল নাগরিক/মাধ্যম হিসেবে মৃত একজন ব্যক্তিকে নিয়ে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার থেকে বিরত থাকুন।
কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আখতার টিবিএসকে বলেন, কারা বিধি অনুযায়ী মাঝে মাঝে বন্দিদের নিরাপত্তার স্বার্থে হাসপাতালে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়। নুরুল মজিদকে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ছবিটি সেসব ভর্তির কোনো এক সময়ে তোলা হতে পারে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা বলছে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বন্দিদের জেল পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে আসে এবং তারা কারা বিধি অনুযায়ী সেসব বন্দিকে হাসপাতালে রাখেন।
তিনি বলেন, 'আমরা শুধু চিকিৎসা দেই। বন্দিদের সঙ্গে সবসময় পুলিশ থাকে। এটি হাসপাতালের বিষয় নয়। নূরুল মজিদ প্রথমে মেডিসিন কেবিনে ছিলেন। পরে আইসিইউতে মারা যান। যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে, সেটি তার মৃত্যুর পরের নয়, বরং হাসপাতালে প্রথম আনার সময় তোলা।'
ডি-কেজের উদ্বেগ
ঢাকাভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ডি-কেজ ইনিশিয়েটিভ ঘটনাটি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, নূরুল মজিদের ছবিগুলো বন্দিদের মর্যাদা, মানবাধিকার ও চিকিৎসার বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে।
এতে বলা হয়, 'আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কেবল একান্ত প্রয়োজনীয় এবং ঝুঁকির মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে হাতকড়া ব্যবহার করা উচিত। বেঙ্গল পুলিশের প্রবিধানে (ধারা ৩৩০) বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত হাতকড়ার ব্যবহার অমানবিক ও অবমাননাকর। বিশেষ করে প্রবীণ, গুরুতর অসুস্থ বা শারীরিকভাবে দুর্বল বন্দিদের ক্ষেত্রে যেখানে পালানোর বাস্তব ঝুঁকি নেই, সেখানে এ ধরনের সীমাবদ্ধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।'
সংস্থাটি কারা বিধির মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশান থেকে নূরুল মজিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার একাধিক মামলায় তিনি আসামি। গ্রেপ্তারের পর থেকে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত প্রবীণ এই রাজনীতিককে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সবশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের মেডিসিন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরদিন সকালে তাকে সিসিইউতে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।