বয়স্ক জনগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

দেশে দ্রুত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সামনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স্কদের সুস্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে তারা অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন, আর এতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে।
তবে এজন্য যেকোনো পরিকল্পনায় বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং চিকিৎসাসেবা সহজ করতে হাসপাতালগুলোতে জেরিয়াট্রিক কেয়ারে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২৩ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশের বয়স ৬০ বা তার বেশি। ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০৩১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১২ শতাংশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বয়স্ক জনগোষ্ঠী যে হারে বাড়ছে সেই তুলনায় আমাদের প্রস্তুতি অনেক কম। দেশের কোথাও এল্ডারলি-ফ্রেন্ডলি অবকাঠামো নেই। রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে বাসে আলাদা ব্যবস্থা নেই, বিনোদনের ব্যবস্থাও নেই। যদি তারা সুস্থ থাকে ও কর্মে যুক্ত থাকতে পারে, তাহলে শ্রমবাজারে অবদান রাখবে, অর্থনীতিকেও সচল রাখবে। এজন্য স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সামাজিক—এই তিন ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।"
তিনি আরও বলেন, "বয়স্ক মানুষের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সেভাবে মনোযোগ ও নীতিতে ফোকাস বাড়াতে হবে। আমরা দ্রুত একটি এজিং সোসাইটির দিকে যাচ্ছি, তাই সব পরিকল্পনার কেন্দ্রে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে রাখতে হবে। এজন্য নিড অ্যাসেসমেন্ট করা জরুরি। জাতীয় নীতিমালাও আপডেট ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বয়স্ক ভাতা মাসে মাত্র ৬৫০ টাকা, যা দিয়ে একজন মানুষ কোনোভাবেই মাস পার করতে পারেন না।"
মইনুল ইসলাম বলেন, "সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি বয়স্কবান্ধব শিল্প গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের খাপ খাওয়াতে হবে। সরকারের নীতিমালা হালনাগাদ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের যদি হিউম্যান ক্যাপিটল হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তাহলেই তারা দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হবে।"
তিনি আরও বলেন, "ফরমাল শ্রমবাজারের পাশাপাশি অনেকেই বয়সের কারণে ইনফরমাল খাতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের জন্য সঠিক খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না হলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। এ ছাড়া পরিবহন, রাস্তাঘাট ও বিনোদন ব্যবস্থায় বয়স্কবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। তাই অবসরের পরও দীর্ঘ কর্মজীবনের সুযোগ তৈরি করা জরুরি। পার্টটাইম চাকরির সুযোগ তৈরি করে বয়স্কদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে তাদের জন্য আলাদা বীমা স্কিম বা ভর্তুকিযুক্ত ভাউচার চালু করা যেতে পারে, যা জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।"
তিনি আরও বলেন, "বয়স্কদের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে সরকারের কোনো বিনিয়োগ নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি খাত উভয়কেই বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে।"
হাসপাতালে 'প্রবীণ ইউনিট' চালুর উদ্যোগ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ধাপে ধাপে বয়স্কদের চিকিৎসাসেবায় বিশেষায়িত ইউনিট স্থাপন করা হবে। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু করা হবে 'প্রবীণ ইউনিট'।
এই ইউনিটে আলাদা চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে পৃথক টিকিট কাউন্টার। বয়স্কদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে বিশেষভাবে নির্মিত টয়লেটও বসানো হবে। রাজধানীতে শুরু হওয়ার পর ধাপে ধাপে সারাদেশে এ সেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সাইদুর রহমান টিবিএস-কে বলেন, "আমাদের নতুন স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় বয়স্ক, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের কিউতেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে আলাদা সেবা দেওয়া হবে।"
আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য: "ওল্ডার পারসন্স ড্রাইভিং লোকাল অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাকশন: আওয়ার অ্যাসপিরেশনস, আওয়ার ওয়েল-বিয়িং, অ্যান্ড আওয়ার রাইটস"। যার বাংলা অনেকটা এরকম—'স্থানীয় ও বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডে প্রবীণদের ভূমিকা: আমাদের আকাঙ্ক্ষা, আমাদের কল্যাণ, আমাদের অধিকার'।