আবুল খায়ের স্টিল: বিশ্বমানের প্রযুক্তিতে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা

বিশ্বমানের ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১০০ ভাগ পরিশোধিত স্টিল উৎপাদন করছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের স্টিল (একেএস)। আধুনিক ইউরোপীয় এই প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং এটি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনছে।
দেশের সেতু, ভবন, সড়ক ও শিল্প স্থাপনায় ব্যবহৃত এ স্টিল শুধু নিরাপত্তাই নিশ্চিত করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণেও ভূমিকা রাখছে। এভাবেই প্রতিষ্ঠানটি 'টেকসই নির্মাণের ভিত্তি, টেকসই বাংলাদেশের অঙ্গীকার' বাস্তবায়নে এগিয়ে চলছে।
কারখানায় প্রতিঘণ্টায় ১৮০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। জাতীয় গ্রিডের ওপর নির্ভরতা কমাতে প্রতিষ্ঠানটি সৌরউৎস থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে।
শুধু সৌরবিদ্যুৎ নয়, সবুজ শিল্পায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পানি শোধনাগার স্থাপন করে অপচয় শূন্যের কোঠায় নামানো, বায়ুদূষণ ঠেকাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রাকৃতিক আলো ব্যবহারের প্রসার এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে উন্নত ব্যবস্থা।
এসবের মাধ্যমে উচ্চশক্তির মানসম্মত রড উৎপাদন করছে আবুল খায়ের স্টিল, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে আস্থা ও স্থায়িত্বের প্রতীক হয়ে উঠছে।

টেকসই ও সবুজ শিল্পে আবুল খায়ের স্টিলের অগ্রযাত্রা
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালে আবুল খায়ের স্টিল কারখানায় স্থাপন করা হয় বিশ্বের সর্বাধুনিক ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (ইএএফ) প্রযুক্তি। ইতালির দানিয়েলি কোম্পানির মেল্টিং ইউনিটে দুটি ফার্নেসে স্ক্র্যাপ গলিয়ে প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করে বিলেট উৎপাদন করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ফিউম ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এফটিপি) ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ডাব্লিউটিপি), যা দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে।
কারখানার যন্ত্রাংশ এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে, এফটিপি বা ডাব্লিউটিপি বন্ধ থাকলে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াই থেমে যাবে। অর্থাৎ দূষণরোধ না হলে উৎপাদন চালু থাকবে না। এছাড়া, দৈনিক ২৬০ টন উৎপাদন সক্ষমতার এয়ার সেপারেশন প্ল্যান্ট অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন সরবরাহ করে।
বিলেট থেকে রড উৎপাদনে ব্যবহৃত রোলিং ইউনিট স্থাপন করেছে জার্মানির এসএমএস কোম্পানি। বিশ্বের দ্রুততম এ ইউনিট প্রতি সেকেন্ডে ৫২.৫ মিটার রড উৎপাদন করে, যা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণও কমায়।
কারখানার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (মেকানিক্যাল) বাদল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "এফটিপি ও ডাব্লিউটিপি ইন-বিল্ট ও ক্লোজ-লুপ সিস্টেমে কাজ করে। দুটি ফার্নেসের জন্য আলাদা এফটিপি রয়েছে। এর মাধ্যমে ক্ষতিকর ফ্লু গ্যাস আলাদা হয়ে বিশুদ্ধ বাতাস নির্গত হয়। আর ডাব্লিউটিপি প্রতি ঘণ্টায় ৭৫০ ঘনমিটার পানি পরিশোধন করে।"
কারখানার পেছনে পাহাড়ের খাজে তৈরি চারটি জলাধার এবং ছাদের পাইপলাইন দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। ২০০৯-১০ সাল থেকে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদন চলছে। সংরক্ষিত পানি দিয়েই সারা বছর কারখানা পরিচালিত হয়।

বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে ছাদের বিভিন্ন স্থানে টিনের পরিবর্তে স্বচ্ছ শিট ও স্কাইলাইট ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে দিনের বেলা বিদ্যুতের বাতি প্রজ্বালন প্রয়োজন হয় না। স্ক্র্যাপ গলানোর সময় উৎপন্ন স্ল্যাগ বর্জ্য ব্যবহার করা হচ্ছে সড়ক নির্মাণে পাথরের বিকল্প হিসেবে।
প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ম্যানেজার (কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স) আবু রায়হান বলেন, "পরিবেশবান্ধব টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের শিল্প খাতে শুধু আমাদের রয়েছে সর্বাধুনিক কোয়ালিটি ল্যাব। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বিশুদ্ধ রড তৈরি হচ্ছে, একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণও কমছে।"
দেশের প্রথম ৭০০ গ্রেডের রড উৎপাদনে আবুল খায়ের স্টিল
বাংলাদেশে এতদিন উচ্চশক্তির রড হিসেবে বাজারে ছিল ৫০০ গ্রেডের রড, যা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ বড় প্রকল্পে ব্যবহার হয়েছে। এর চেয়ে উন্নত গ্রেডের রড দেশে অনুমোদিত ছিল না।
চলতি বছর প্রথমবারের মতো আবুল খায়ের স্টিল ৭০০ গ্রেডের রড উৎপাদনের অনুমোদন পেয়েছে। ফলে এখন দেশের মেগা অবকাঠামোতেও এ রড ব্যবহার করা যাবে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ৪২০, ৫০০, ৬০০ ও ৭০০ গ্রেডের রড উৎপাদন করছে।
প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাকাউন্টস) মো. রেজওয়ানুল আলম, এফসিএ টিবিএসকে বলেন, "গত মার্চে আমরা প্রথম ৭০০ গ্রেডের রড বাজারজাত করার অনুমতি পেয়েছি। আমাদের মাসে আড়াই লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত রড তৈরির সক্ষমতা রয়েছে।"
আবুল খায়ের স্টিল ১৯৯৩ সালে ঢেউটিন উৎপাদনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। জনপ্রিয় 'গরু মার্কা' ঢেউটিন ব্র্যান্ডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত বাজারে শীর্ষে পৌঁছে যায়। ২০০৯ সালে রড উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে এর মেল্টিং ইউনিটের বার্ষিক সক্ষমতা প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন এবং দুটি রোলিং মিলে ৩০ লাখ মেট্রিক টন রড উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান মোমিন টিবিএসকে বলেন, "আবুল খায়ের স্টিল সর্বদা বিশ্বমানের মানসম্পন্ন স্টিল উৎপাদনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা নিম্ন কার্বন নির্গমন নিশ্চিত করতে কাজ করছি। পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছি। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো এমন স্টিল উৎপাদন করা, যা আরও নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক হবে। পাশাপাশি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের মাধ্যমে অর্থনীতিতেও অবদান রাখছি।"
আবুল খায়ের গ্রুপের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ও লিগ্যাল বিভাগের প্রধান শেখ শাবাব আহমেদ বলেন, "জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আবুল খায়ের স্টিলের পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমাদের গ্রিন অ্যাপ্রোচ শুধু কার্বন নির্গমন কমাচ্ছে না, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার, পরিবেশ সুরক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে এসডিজি অর্জনে অবদান রাখছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের কার্যক্রম সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ১৩টি এসডিজিতে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে এসডিজি-৬ (নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন), এসডিজি-৭ (সাশ্রয়ী ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি), এসডিজি-৯ (শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো) এবং এসডিজি-১১ (টেকসই নগর ও বসতি)। টেকসই নির্মাণে এসব প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।"
আবুল খায়ের স্টিলের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার স্বীকৃতি
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে আবুল খায়ের স্টিল বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থা অর্জন করেছে। এর ফলে প্রকল্পে অর্থায়ন ও অংশীদারিত্বে এগিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, যেমন—নরওয়ের এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সি জিআইইকে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি), এইচএসবিসি, ইসলামিক কর্পোরেশন ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব দ্য প্রাইভেট সেক্টর (আইসিডি), সৌদি আরব–যা ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের গ্রুপের একটি অঙ্গসংস্থা।
এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মূলত আবুল খায়ের স্টিলের সবুজ উদ্যোগ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডে টেকসই উৎপাদন চর্চার প্রতি অটল প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন। এটি শুধু প্রতিষ্ঠানটির জন্য নয়, বরং গোটা জাতির জন্যই এক অনন্য গৌরব ও মর্যাদার বিষয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সরকার নীতিগতভাবে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে যে, ভবিষ্যতে দেশের সকল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে কেবল পরিশোধিত স্টিল উৎপাদনে অঙ্গীকারবদ্ধ করা হয়, তবে তা হবে দৃঢ় ও স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন। এই পদক্ষেপ শুধু টেকসই অবকাঠামোই নয়, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও জাতীয় স্থায়িত্বের ভিত্তিও সুদৃঢ় করবে।