ইস্পাতে পরিবেশবান্ধব ও সর্ববৃহৎ কারখানা আবুল খায়েরের

বিশেষায়িত চুল্লিতে ১,৬০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ১০০ টন স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরা গলানো হচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিকের পাশাপাশি অক্সিজেন ও কার্বন দিয়ে এই পরিশোধনপ্রক্রিয়া চলছে। চুল্লির ওপরে জমা হচ্ছে অপদ্রব্য। সেগুলো আবার চুল্লি থেকে ফেলেও দেওয়া হচ্ছে।
এভাবে মাত্র ৪৮ মিনিটে উৎপাদিত হচ্ছে বিশুদ্ধ তরল লোহা।
তরল লোহা আবার নির্দিষ্ট ছাঁচ দিয়ে বিলেট আকারে বের হচ্ছে। ওই বিলেট থেকে আবার কয়েক মিনিটে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন মাপের রড।
এত বড় কর্মযজ্ঞ, অথচ কর্মী খুবই কম। মেল্টিং সেকশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষে মাত্র কয়েকজন প্রকৌশলী স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালনা করছেন।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শীতলপুরে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লিমিটেডের (একেএসএমএল) কারখানায় সম্প্রতি ঘুরে এমনটি দেখা গেছে।
কারখানার কর্মকর্তারা বলছেন, একেএসের কারখানায় স্ক্র্যাপ থেকে বিশুদ্ধ লোহা উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (ইএএফ) নামের বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তির। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে প্রথম এই প্রযুক্তি নিয়ে আসে একেএস। বর্তমানে তাদের দুটি ইএএফ রয়েছে, যেগুলোর সক্ষমতা বার্ষিক ২০ লাখ টন।
সম্প্রতি আধুনিক একটি রি-রোলিংয়ের ইউনিট চালু করেছে তারা। শিগগিরই এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে। তখন এককভাবে দেশের সবচেয়ে বেশি রড উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করবে কোম্পানিটি।
একেএসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান মোমিন বলেন, "পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ প্রায় সব মেগা প্রজেক্টে ব্যবহৃত হয়েছে একেএস স্টিল। ভবিষ্যতের সব নির্মাণের সহযোগী হতে প্রোডাক্ট ক্যাপাসিটি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি পরিবেশকে সর্বোচ্চ দিয়েছে আবুল খায়ের।"
"পুরো উৎপাদনপ্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব করতে পানির আঁধার গড়ে তোলার পাশাপাশি বায়ু পরিশোধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগ করছি আমরা," যোগ করেন তিনি।
পরিবেশবান্ধব রড উৎপাদন
কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, দেশের অন্যতম বৃহৎ এই কারখানায় পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে রড উৎপাদন হয়। রড উৎপাদনে প্রচুর পানি লাগে, যদিও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেন না তারা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও কারখানা–সংলগ্ন পাহাড়ে গড়ে তোলা ড্যামের পানি ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকে বড় পাইপের মাধ্যমে পানি কারখানায় নেওয়া হয়। এই পানি স্থানীয় লোকজনও ব্যবহার করেন।
এছাড়া, বায়ুদূষণ রোধে ফিউম ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে। বর্তমানে কারখানার বিশাল ছাদে ১২ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ চলছে।
একেএসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান মোমিন বলেন, "কোনো কারখানাই শতভাগ দূষণমুক্ত নয়। তবে আমরা চেষ্টা করেছি একেএস স্টিল মিলসের মাধ্যমে যেনো পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি না হয়। এজন্য ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনতে ফিউম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে দূষিত ধোয়া বের হচ্ছে না। অন্যদিকে, শতভাগ রেইন ওয়াটার ব্যবহারের কারণে ওয়াটার লেভেলের ওপর প্রেশার পড়ছে না।"
তিনি বলেন, "ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে স্ক্র্যাপ পরিশোধনের মাধ্যমে প্রায় শতভাগ বিশুদ্ধ বিলেট উৎপাদন করা যায়। সেজন্য ভূমিকম্প সহনশীল রড সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। এই প্রযুক্তি বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী।"
রড উৎপাদনের সর্ববৃহৎ কারখানা
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একেএসের কারখানায় রড উৎপাদন শুরু হয় ২০০৯ সালে। কিছুদিন আগেও বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১২ লাখ টন। তবে নতুন রি-রোলিং ইউনিটের একক সক্ষমতা হতে যাচ্ছে ১৮ লাখ টন। এতে করে তাদের বার্ষিক রড উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০ লাখ টনে; যা দেশের অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি—এমনটাই জানালেন একেএসের কর্মকর্তারা।
তবে টেকনিক্যাল কারণে বিনিয়োগের পরিমাণ জানাতে চাননি তারা।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) হিসাবে, দেশে ইস্পাতখাতে স্বয়ংক্রিয় কারখানা প্রায় ৪০টি। তারমধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪-৫টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে এক কোটি টনের বেশি রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। দেশে রডের বার্ষিক ব্যবহার ৬৫-৭০ লাখ টন। ফলে কারখানাগুলোর সক্ষমতার একটি অংশ এখনও অব্যবহৃত।
ঢেউটিনে বিনিয়োগের পরিকল্পনা
সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাট এলাকায় আবুল খায়ের স্টিল প্রোডাক্টস নামের কারখানায় ঢেউটিন উৎপাদন হয়। ১৯৯৩ সালে ৩০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত আবুল খায়েরের এই কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা ৬.৪ লাখ মেট্রিক টন। তাদের উৎপাদিত গরু মার্কা ঢেউটিন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাজারের শীর্ষস্থান দখল করে আছে।
আবুল খায়ের স্টিল প্রোডাক্টসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এজাজ আহমেদ বলেন, "বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় অর্ধেক সক্ষমতায় এই কারখানা চালানো হচ্ছে। তবে বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় রঙিন টিনের ব্যবহার বাড়ছে। সেজন্য আমরা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছি।"
বিড়ির কারখানা থেকে প্রায় সব শিল্পে
১৯৪৬ সালে নোয়াখালী থেকে প্রায় শূন্য হাতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন যুবক আবুল খায়ের। তারই হাত ধরে ১৯৫৩ সালে বিড়ির কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে আবুল খায়ের গ্রুপের গোড়াপত্তন।
বর্তমানে ইস্পাত ছাড়াও সিমেন্ট, শিপিং, সিরামিক, গুড়া দুধ, চাসহ বিভিন্ন খাতে ৪০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে গ্রুপটির। এসব কারখানায় ৫৫ হাজার কর্মী কাজ করেন। গত অর্থবছরে তাদের লেনদেন ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন করে খাদ্যপণ্যের মার্কেটেও বড় বিনিয়োগ করছে কোম্পানিটি।