বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বিল বকেয়া বিপিডিবির কাছে, তবু সরবরাহে ঘাটতির জন্য জরিমানা

বিদ্যুৎ কেনার বিল সাত মাস পর্যন্ত পরিশোধে বিলম্ব করলেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) ওপর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য জরিমানা আরোপ করছে।
এই জরিমানাগুলো 'লিকুইডেটেড ড্যামেজেস' (এলডি) নামে পরিচিত, যা কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ, সক্ষমতা বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হলে আরোপিত হয়।
তবে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা বলছেন, এই পদক্ষেপ একেবারেই স্বেচ্ছাচারী এবং চুক্তিভঙ্গের শামিল, কারণ বিদ্যুৎ ঘাটতির মূল কারণ বিপিডিবির দীর্ঘস্থায়ী বিল পরিশোধে দেরি, যার ফলে জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনজনিত অবহেলার কারণে নয়।
ইতিমধ্যে ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সরবরাহের ঘাটতির কথা উল্লেখ করে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মোট ২৪৯.৭৫ কোটি টাকা এলডি কেটে নিয়েছে বিপিডিবি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অন্তত ১৭টি আইপিপি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) অভিযোগ দায়ের করেছে, যাতে বিপিডিবিকে এই কর্তন বন্ধ করতে এবং বকেয়া বিল পরিশোধে নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
এসব কেন্দ্রের কাছে বিপিডিবির বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪,৪২২ কোটি টাকারও বেশি।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সংগঠন– বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সভাপতি ডেভিড হাসানাত বলেন, "চুক্তি ভঙ্গ করে বিপিডিবি আইপিপি মালিকদের থেকে এলডি কেটে নিচ্ছে, আমরা এটি বিইআরসিতে চ্যালেঞ্জ করেছি। যে তারিখে পরিশোধ করার কথা তার ছয়-সাত মাস পরেও বিল দিচ্ছে না, অথচ আউটেজের জন্য জরিমানা করছে। যদি বিইআরসিতে প্রতিকার না পাই, তাহলে হাইকোর্টে এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাব।
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) অনুযায়ী, বিপিডিবি নির্দিষ্ট সময়ে বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বছরের ট্রেজারি নোটের মুনাফা হার সঙ্গে ৪ শতাংশ সুদ দিতে বাধ্য। কিন্তু শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপিডিবি খুব কম ক্ষেত্রেই এই ধারা মানে।
এনিয়ে তাঁর মন্তব্য জানতে চাইলে বিপিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের শুনানি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে উল্লেখ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো
যে চারটি কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যেই এলডি কাটা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ১৬২ মেগাওয়াট ক্ষমতার মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন। কেন্দ্রটির কাছে বিপিডিবির ৫৪২ কোটি টাকা বকেয়া থাকলেও ১৪২ কোটি টাকা এলডি জরিমানা কেটে নেওয়া হয়েছে। চাঁদপুর পাওয়ার জেনারেশনের কাছে ৩২৯ কোটি টাকা বকেয়া, তবু ৭৮ কোটি টাকা জরিমানার সম্মুখীন হয়েছে।
এ ছাড়া কাঞ্চন পূর্বাচল পাওয়ার জেনারেশনের বকেয়া ১১৪ কোটি টাকা থেকে ১১.৬ কোটি টাকা এবং ইউনাইটেড পাওয়ার জামালপুরের বকেয়া ৬৩ কোটি টাকা থেকে ১৭.৬ কোটি টাকা কর্তন করা হয়েছে।
বেসরকারি একটি বিদ্যুৎ কোম্পানির একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী সতর্ক করে বলেন, "এমন কর্মকাণ্ড বেসরকারি বিদ্যুৎখাতের আর্থিক সংকট আরও বাড়াবে। জ্বালানি সংকট, বাড়তি ব্যয় ও ঋণপ্রাপ্তির সীমাবদ্ধতার কারণে বেসরকারি উৎপাদকরা আগে থেকেই বিপাকে। তার মধ্যেই এই স্বেচ্ছাচারী, অযৌক্তিক কর্তন বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাত সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ক্ষয় করবে।"
এমন একটি ঘটনার উদাহরণ, ১১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার এইচএফও-ভিত্তিক ইউনাইটেড পাওয়ার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ বিপিডিবিকে ৬৩.৮৩ কোটি টাকার বিল দেয়, যা পরিশোধের সময়সীমা ছিল ১৪ মার্চ। কিন্তু বিপিডিবি ২৩ জুলাই ১৩১ দিন বিলম্ব করে মাত্র ৪৬.১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করে, বাকি ১৭.৬৫ কোটি টাকা আউটেজ জরিমানা বাবদ কেটে নেয়।
পিপিএর ধারা ১৩.২(জে) অনুযায়ী, যদি বিপিডিবি নির্ধারিত তারিখ থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে বিল পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের আউটেজ জরিমানা আরোপের অধিকার বাতিল হয়ে যায়।
বিইআরসির অন্তর্বর্তী নির্দেশনা
গত এপ্রিলে প্রথম পর্বের শুনানির পর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এলডি কর্তনের ওপর সাময়িক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। বিপিডিবিনিয়মিত বিল পরিশোধে ধারাবাহিকভাবে দেরি করলেও কেন এই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তার ব্যাখ্যাও চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
অন্তর্বর্তী এ আদেশ ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল থাকবে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, বিইআরসি স্বীকার করবে যে জরিমানাগুলো পিপিএর ধারার পরিপন্থী।
আর্থিক সংকটের মধ্যে স্থগিতাদেশ ভঙ্গ করে বিপিডিবি
২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তীব্র আর্থিক সংকটকালে, সময়মতো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে হিমশিম খায় বিপিডিবি। এরপর বিপ্পার অনুরোধে ২০২৪ সালের ১৫ মে বিপিডিবি সিদ্ধান্ত নেয় যে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি প্ল্যান্টের এলডি কর্তন স্থগিত থাকবে। তারপরেও যখন বিপিডিবি সময়মতো বিল পরিশোধে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল— তখন এ মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
তখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছিল, এ পদক্ষেপ পিপিএর ধারা ১৩.২(জে) এবং জাতীয় লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) পরিচালন কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তবে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বিপিডিবি আবারও জরিমানা আরোপ শুরু করেছে, যা নিয়ে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ছে বিইআরসিতে।
এলডি আরোপের ঝুঁকিতে আরও অনেক কেন্দ্র
বিইআরসি জানিয়েছে, ২১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বিল পরিশোধে দেরির কারণে বিপিডিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে, এবং এদেরও এলডির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) হাতে আসা ১৭টি কেন্দ্রের অভিযোগপত্রের কপিতে দেখা যায়, তাদের কাছে বিপিডিবির বকেয়া বিলের পরিমাণ ৪,৪২২.৫৫ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বড় দাবিগুলোর মধ্যে— কনফিডেন্স পাওয়ার বগুড়ার রয়েছে ৪৮৩.৬২ কোটি টাকা এবং কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুরের ৪৫৩.১০ কোটি টাকা; তাদের বিল ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আটকে আছে।
এ ছাড়া ঢাকা নর্দার্ন পাওয়ার জেনারেশন -এর ১৫০.২৫ কোটি টাকা, বেনকো এনার্জি জেনারেশন ২৩০.৫৬ কোটি টাকা, মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন ৫৪২.০৪ কোটি টাকা, চাঁদপুর পাওয়ার জেনারেশন ৩২৯.৮৮ কোটি টাকা, ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ১৮০.৮৭ কোটি টাকা এবং ওরিয়ন পাওয়ারের মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র ১৯২.৮৭ কোটি টাকার বিল বকেয়া রয়েছে।
২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁওয়ের বকেয়া ২৪১.২১ কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওরিয়ন পাওয়ার রূপশার বকেয়া ১৯৮.০২ কোটি টাকা।
কেন আইপিপিগুলো বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে
আইপিপি মালিকরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিপিডিবি নিয়মিতভাবে সময়মতো বিল দেয় না। অনেক সময় ছয়-সাত মাস দেরি হয়, আর করোনা মহামারির পর ২০২১ সালের পর থেকে কিছুক্ষেত্রে এ বিলম্ব ১৮০ দিন থেকে ৩০০ দিনেরও বেশি হচ্ছে।
বিপ্পার সভাপতি ডেভিড হাসানাত বলেন, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বিপিডিবির অনিয়মিত পেমেন্টের কারণে ব্যাংকগুলো এইচএফও, লুব্রিকেন্ট ও যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য এলসি খুলছে না। ফলে আমরা সীমিত ক্ষমতায় চলতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ বিদ্যুৎ ঘাটতির দায়ে বিপিডিবি আমাদের জরিমানা করছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।"
অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকরা জানান, তাদের জ্বালানি খরচ মোট পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ। দেরিতে ক্যাপাসিটি বিল মেটানোর কারণে ব্যাংকও তাদের ঋণ দিতে চাইছে না; ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ, ঋণ পরিশোধসহ অন্যান্য প্রকল্প ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
পিপিএ অনুযায়ী, আইপিপিগুলো বছরে সর্বোচ্চ ৮৭৬ ঘণ্টা পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে পারে। এর বেশি ঘাটতি হলে বিপিডিবি এলডি আরোপ করতে পারে। তবে ধারা ১৩.২(জে) বলছে, যদি নির্ধারিত তারিখ থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কোনো কোম্পানির বিল পরিশোধ না হয়, তবে এসব আউটেজকে "বাধ্যতামূলক আউটেজ" ধরা হবে, যার দায় বিপিডিবির। এমনকি এই ধারায়, বিল জমা দেওয়ার ৪০ দিনের মধ্যে তা না মিটলে আইপিপিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থগিত রাখারও অধিকার দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যাত্রা শুরু যেভাবে
১৯৯৬ সালে বেসরকারি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি প্রণয়ন করে বিপিডিবি প্রথম বেসরকারি উৎপাদনকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায়– বিদ্যুৎখাতে বেসরকারি মূলধন আকৃষ্ট করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) একটি স্ট্যান্ডার্ড পিপিএ তৈরিতে সহায়তা করে, যেখানে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে সরকারের বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
এই মডেল সফল হয়। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা দ্রুত উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ান। এতে লোডশেডিং কমে আসে আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও সমর্থন পায়।
বর্তমানে আইপিপিগুলো দেশের মোট স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করছে, যা জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছে। প্রথম আইপিপি, এএস করপোরেশনের ৩৬০ মেগাওয়াটের হরিপুর কম্বাইন্ড সাইকেল প্লান্ট, ১৯৯৮ সালে চালু হয়—যা বেসরকারি বিনিয়োগের নতুন যুগের সূচনা করে।