ডাকসুর পর জাকসুতেও ছাত্রদলের ভরাডুবি; ভুল কোথায়?

সপ্তাহব্যাপী প্রচারণা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে একটি পদে জিততেও ব্যর্থ হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
ছাত্রদলের প্রার্থীরা প্রতিটি পদেই বিজয়ীদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলেন। ভোটের হিসাবে দেখা যায়, বিজয়ী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় তাদের ভোট ছিল সামান্যই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেও ছাত্রদলকে একই ধরনের পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যেখানে ইসলামী ছাত্র শিবির বড় ব্যবধানে বিজয় লাভ করে।
তাহলে ভুলটা কোথায় হলো? বিএনপি-পন্থী ছাত্র সংগঠনটির অভিযোগ অনুযায়ী নির্বাচনে কি সত্যিই অনিয়ম, ভোট কারচুপি এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব ছিল? নাকি এটি ছিল কেবলই দুর্বল কৌশলের ফল?
কিছু নির্বাচন পর্যবেক্ষক শিবিরের শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি, তৃণমূল পর্যায়ের কার্যক্রম, কৌশলগত প্রার্থী মনোনয়ন এবং বিভক্ত বিরোধী শিবিরকেই তাদের বড় জয়ের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর বিপরীতে, ছাত্রদলের কার্যকর পাল্টা কৌশল তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়াই তাদের একপাশে ছিটকে দিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা আরও অভিযোগ করেছেন যে, ভিপি পদে শিবিরের 'ডামি প্রার্থী' ব্যবহার করা স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতুর জয়ের পথকে সুগম করেছে।
এর বিপরীতে, ছাত্রদল একটি আসনও নিশ্চিত করতে পারেনি। বিজয়ী প্রার্থীদের তুলনায় তাদের ভোটের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে এক-তৃতীয়াংশ বা তারও কম ছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী পেয়েছেন মাত্র ৬৪৮ ভোট, যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু ৩,৩৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। একইভাবে, তাদের জিএস প্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী পেয়েছেন মাত্র ৯৪১ ভোট, যেখানে শিবিরের মাজহারুল ইসলাম ৩,৯৩০ ভোট পেয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন।
এই চিত্রটি প্রায় প্রতিটি পদেই পুনরাবৃত্তি হয়েছে: ছাত্রদলের প্রার্থীরা যেখানে শতকের ঘরে ভোট পেয়েছেন, বিজয়ীরা সেখানে হাজার হাজার ভোট নিশ্চিত করেছেন। এমনকি তাদের সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থী, নাট্য সম্পাদক পদের আমিনুল ইসলাম, পেয়েছেন ১,৬৫৬ ভোট—যা বিজয়ী প্রার্থীর ভোটের চেয়ে অনেক কম।
ছাত্রদল প্রার্থীরা কী বলছেন?
জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের এমন ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সদস্য সচিব ওয়াসিম আহমেদ অনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা ভোট বন্ধ করেছি আমাদের ভরাডুবি হয়নি, ভোট শেষ হওয়ার ২ ঘন্টাও আগে বিভিন্ন অনিয়মের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বারবার জানিয়েও আমরা তার কোন প্রতিকার পাইনি তাই আমরা এই নির্বাচনকে বর্জন করেছি।"
শিক্ষক রাজনীতি ছাত্রদলের পরাজয়কে প্রভাবিত করেছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে অনিক বলেন, বর্জনকারী দুটি সংগঠন—জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম এবং ছাত্রদল দুটি ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এবং তাদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিলনা।
তিনি আরও বলেন যে চারটি পৃথক প্যানেল নির্বাচন বর্জন করেছে। জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্যসহ তিনজন শিক্ষকও বর্জন করেছেন। এছাড়াও, এই নির্বাচনটি অত্যন্ত অনিয়মিত এবং কারচুপিপূর্ণভাবে পরিচালিত হয়েছে বলে একে সমর্থন না করার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
ছাত্রদল প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী বলেন, "আমি মনে করি না ছাত্রদলের এই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে। ছাত্রদলের সবথেকে বড় সফলতা হচ্ছে কারচুপির নির্বাচনকে বৈধতা দেয়নি, বয়কট করেছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা মনে করি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে ছাত্রদলের বিজয় হয়েছে৷ এই নির্বাচন একটি স্বচ্ছ নির্বাচন ছিল না। একটা অবৈধ নির্বাচনে আমরা জিতি কিংবা হারি সেখানে এসে অংশগ্রহণ করে বৈধতা দেয়ার কোন মানে হয় না। সবকিছুই প্রিডিটারমাইন্ড, প্রত্যেকটা জিনিসেই প্রশাসন বাড়তি সু্যোগ দিয়েছে, কারচুপির নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক সে নিয়ে আমরা মাথা ব্যথা নিচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করলেও নির্বাচনের যে কারচুপি হয়েছে তা ফের হতোই যেহেতু ছাত্রদল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি।"
শেষ মুহূর্তের বর্জনে নির্বাচন বিতর্কিত
ভোটগ্রহণের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্রদল-সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। তারা ব্যাপক অনিয়ম, জাল ব্যালট, পোলিং এজেন্টদের বাধা দেওয়া এবং শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতি প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন।
একইভাবে, জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের তিনজন সদস্যও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ আখ্যা দিয়ে বর্জন করেন।
এর মধ্যেই, অভিযোগের সমাধান না হওয়ায় বিএনপি-সমর্থিত নির্বাচন কমিশন সদস্য মাফরুহি সাত্তার পদত্যাগ করলে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আরও জোরালো হয়।
টানা তিন দিনের ম্যানুয়াল ভোট গণনার পর গতকাল সন্ধ্যায় (১৩ সেপ্টেম্বর) জাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত, শিবির-সমর্থিত প্যানেল ২৫টি কেন্দ্রীয় পদের মধ্যে ২০টিতেই ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তিনটি এবং বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) দুটি আসন লাভ করে।
ছাত্রদলের প্রার্থী ও প্রাপ্ত ভোটের তালিকা:
সহ-সভাপতি (ভিপি): শেখ সাদী হাসান – ৬৪৮ ভোট
সাধারণ সম্পাদক (জিএস): তানজিলা হোসাইন বৈশাখী – ৯৪১ ভোট
সহ-সাধারণ সম্পাদক (নারী): আঞ্জুমান আরা ইকরা – ৭৬৪ ভোট
সহ-সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ): সাজ্জাদুল ইসলাম – ৭০১ ভোট
শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক: ইয়ামিন হাওলাদার – ৪৩৫ ভোট
পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সম্পাদক: লিখন চন্দ্র রায় – ১,২৬৮ ভোট
সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক: জাহিদ হাসান খান – ৬৩৮ ভোট
সাংস্কৃতিক সম্পাদক: আবিদুর রহমান – ৬৩৫ ভোট
নাট্য সম্পাদক: আমিনুল ইসলাম – ১,৬৫৬ ভোট
তথ্যপ্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক: জাবের হাসান – ৬৮২ ভোট
সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক: তৌহিদুল রহমান খান – ৬৩৩ ভোট
সহকারী সমাজসেবা (পুরুষ): শাকিল সরদার – ৫৭০ ভোট
সহকারী সমাজসেবা (নারী): কাজী মৌসুমী আফরোজ – ৭২৩ ভোট
ক্রীড়া সম্পাদক: উজ্জ্বল হাসান – ৫৪৩ ভোট
সহকারী ক্রীড়া সম্পাদক (পুরুষ): রুহুল আমিন সুইট – ৯০২ ভোট
সহকারী ক্রীড়া সম্পাদক (নারী): শাহনাজ পারভীন (শানু) – ৮২৩ ভোট
পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক: জাহিদুল ইসলাম – ৭৭৭ ভোট
স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা সম্পাদক: মোমিনুল ইসলাম – ১,০৯১ ভোট
কার্যনির্বাহী সদস্য (নারী):
সুমাইয়া সুলতানা – ৪৮৭ ভোট
হ্যাপি আক্তার শিলা – ৬৬৭ ভোট
শায়লা সাবরিন – ৯৬৫ ভোট
কার্যনির্বাহী সদস্য (পুরুষ):
হামিদুল্লাহ সালমান – ১,১৭৭ ভোট
মেহেদী হাসান – ৭৫৩ ভোট
এ এম রাফিদুল্লাহ – ৮০৭ ভোট