বাস্তবায়ন শঙ্কার মাঝেই ১ লাখ স্মার্ট মিটার বসানোর পরিকল্পনা চট্টগ্রাম ওয়াসার
চট্টগ্রাম ওয়াসার ৯৪ হাজারের বেশি গ্রাহকের মিটার রিডিং নেওয়ার দায়িত্বে আছেন মাত্র ৩৭ জন মিটার পরিদর্শক। সব গ্রাহকের থেকে বিল আদায় না হওয়ার পাশাপাশি মিটার পরিদর্শকদের যোগসাজশে বিল কমিয়ে দেওয়াসহ অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে পানি চুরির অভিযোগও দীর্ঘদিনের।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পাইলট প্রকল্পের অধীনে তিন হাজার স্মার্ট মিটার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সংস্থাটি—কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। এখন বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় আরেকটি প্রকল্পের অধীনে প্রায় ১ লাখ স্মার্ট মিটার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। তবে তা বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে খোদ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, ২০২২ সালে ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ে পাইলট প্রকল্পের অধীনে নগরীর চাঁদগাও জোনের তিন হাজার গ্রাহক সংযোগে স্মার্ট মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মিটার আমদানি, স্থাপন ও কারিগরি ত্রুটি সারাতে গিয়ে প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়ে চলতি বছরের মে মাসে সম্পন্ন হয়। এখনও কিছু মিটারে ত্রুটি রয়েছে, সেগুলো বদলানো প্রয়োজন।
পাইলট প্রকল্পটি দেখভাল করছেন সংস্থাটির সিস্টেম অ্যানালিস্ট (চলতি দায়িত্ব) ও কম্পিউটার প্রোগ্রামার লুৎফি জাহান। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'কিছু মিটারের ত্রুটি ছিল। পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি আছে। সেগুলো পরিবর্তন করা হবে। আর গেটওয়ের কারণে কিছু মিটার এখনও চালু হয়নি। দ্রুত তা চালু করা হবে। নিয়মিত মিটার রিডিং আমরা পাচ্ছি।'
নতুন ১ লাখ মিটার স্থাপন বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা
চট্টগ্রামের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প চলতি বছরের এপ্রিলে সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় নেওয়া প্রকল্পটির অধীনে ৩৭৫ কিলোমিটার নতুন পাইপলাইন স্থাপন, ৪৬টি ডিএমএ (ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া) স্থাপনের পাশাপাশি প্রায় এক লাখ মিটার স্থাপনের কথা রয়েছে। স্মার্ট মিটার ও ডেটা সিস্টেমের পেছনে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রকল্পে।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথমে ৩০ হাজার স্মার্ট মিটার স্থাপন করে তা পর্যালোচনা করা হবে। এরপর সফলতার ভিত্তিতে বাকিগুলো বসানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে মিটার পরিদর্শক ও রাজস্ব শাখার কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ সব সংযোগ স্মার্ট মিটারের আওতায় এলে অবৈধ উপায়ে পানি বিক্রি ও বিল কমিয়ে ঘুষ আদায় নির্মূল হবে। এমনকি পাইলট প্রকল্পের ৩ হাজার মিটার নিয়েও রাজস্ব শাখার ভেতর থেকে অভিযোগ উঠেছিল।
চট্টগ্রাম ওয়াসার দুজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'মিটার বসালে তা নষ্ট করে দিয়ে অভিযোগ করার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ পাইলট প্রকল্পের তিন হাজার মিটারের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। কারণ স্মার্ট মিটার বসালে বড় সিন্ডিকেটের অবৈধ আয়ে ভাটা পড়বে। আর মিটারের কারিগরি ত্রুটির দায় প্রকৌশল বিভাগকেই নিতে হবে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংককে বাস্তবতা বোঝানো হয়েছে। তারা চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনা করবে বলেছে। আর ইউরোপিয়ান মিটার সংগ্রহের প্রতি জোর দেওয়া হবে।'
প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, 'পরামর্শক সংস্থা দিয়ে সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করা হবে। এরপর চূড়ান্তভাবে স্মার্ট মিটার বসানো হবে। শর্ত অনুযায়ী, মিটার স্থাপন করার পর এক বছর বিল তুলে অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার কমানোর পর ঠিকাদার কাজ বুঝিয়ে দেবে। আগের তিন হাজার মিটারের অভিজ্ঞতাও পর্যালোচনা করা হবে।'
সিস্টেম লস কমানোর চ্যালেঞ্জ
চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমানে ৯৪ হাজারেরও বেশি সংযোগ রয়েছে—৯৩ শতাংশ আবাসিক ও ৭ শতাংশ বাণিজ্যিক। নগরীর প্রায় ৩২ লাখ মানুষ সংস্থাটির সেবার আওতায় রয়েছে। তবে সংযোগ থাকা অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত পানি পায় না।
সংস্থাটির দৈনিক পানি উৎপাদনের সক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। ভান্ডাল-জুড়ির পানি সরবরাহ প্রকল্প সম্পন্ন হলে ৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়বে, যদিও তা মূলত নগরীর বাইরে সরবরাহ করা হবে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে পানির দৈনিক চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। ২০৩২ সালে তা দাঁড়াবে ৭০ কোটি লিটার; আর ২০৪০ সালে হবে ১২২ কোটি লিটার।
চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদিত অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার ২৫-৩০ শতাংশ। অথচ বৈশ্বিক মানদণ্ডে এর স্বাভাবিক হার ৫ শতাংশের কম। অর্থাৎ মাসে ১৪-১৭ কোটি টাকার পানির হিসাব পাওয়া যায় না। রাজস্ব শাখার মিটার পরিদর্শকসহ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সংস্থাটি বড় অংকের রাজস্ব হারায় বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ।
সম্প্রতি সমাপ্ত ৩ হাজার ৮২ কোটি টাকার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০২-এর অধীনে ৬৯২ কিলোমিটার ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন, ৫৯টি ডিএমএ ও ৩৫.৩ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার কমার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।
প্রকল্পটির নথি অনুসারে, মোট ৫৯টি ডিএমএর মধ্যে ৩৯টি ডিএমএতে অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার সর্বনিম্ন ০.২ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ। তবে বেশিরভাগ ডিএমএতে তা ১০ শতাংশের কম।
অ-রাজস্বভুক্ত পানির হিসাবের গরমিল নিয়ে ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান চালিয়েছিল সংস্থাটি। এতে উঠে আসে, লিকেজ সমস্যার কারণে উৎপাদিত পানির মাত্র ৩.৮৯ শতাংশ অপচয় হয়। বাকি পানি অবৈধভাবে বিক্রি বা আহরণ করা হয় বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ফলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে অ-রাজস্বভুক্ত পানি হার কমবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রুমন দে টিবিএসকে বলেন, '৯৪ হাজার সংযোগের জন্য মাত্র ৩৭ জন মিটার পরিদর্শক আছেন। অথচ প্রয়োজন অন্তত ৮০ জন। মাসে ৮টি করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার কমানো ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার ২২-২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তা আরও কমে আসবে বলে আশা করছি।'
মিটার রিডিং অ্যাপ চালু
অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার কমাতে জাইকার অর্থায়নে মিটার রিডিং অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে অ্যাপের ব্যবহার শুরু করেছে চট্টগ্রাম। এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার সংযোগের মিটার রিডিংয়ে অ্যাপটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসায় বর্তমানে উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রিপোর্টিং এক্সেল-এ লিপিবদ্ধ করা হয়। বিলিং পদ্ধতি সম্পূর্ণ ম্যানুয়াল। মিটার পরিদর্শক সংযোগগুলোর মিটার রিডিং, আইটি বিভাগের মাধ্যমে বিল তৈরি ও বিল পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন। মিটার রিডিং থেকে শুরু করে বিল সংগ্রহ— পুরো চক্রে সময় লাগে ১২ সপ্তাহ। ম্যানুয়াল হওয়ায় বিলিং ব্যবস্থায় ৩০ শতাংশ ত্রুটি থাকে।
নতুন অ্যাপটির মাধ্যমে সংস্থাটির বিলিং পদ্ধতি অটোমেটেড করা হচ্ছে। মিটার পরিদর্শক গ্রাহকের মিটার রিডিংয়ের তথ্য অ্যাপে ইনপুট দেবেন। গ্রাহকের আগের বিলিং হিস্ট্রির হিসাব করে অটোমেটেড বিল তৈরি হবে। মিটার পরিদর্শক সঙ্গে থাকা পকেট প্রিন্টারের মাধ্যমে বিলের কপি গ্রাহককে দেবেন। গ্রাহক কিউআর কোড ব্যবহার করে বিল পরিশোধ করতে পারবেন। মিটার রিডিংয়ের সময় মিটারের ছবি অ্যাপে যুক্ত করতে হবে। জিপিএস ট্র্যাকার দিয়ে মিটার পরিদর্শকের লোকেশন ট্র্যাক করা যাবে। ফলে গ্রাহকের মিটার না দেখে বিল তৈরির সুযোগ নেই। এছাড়া অ্যাপটি অফলাইনেও পরিচালনা, তথ্যের সত্যতা যাচাই, রোস্টার ম্যানেজমেন্ট ফিচার থাকবে।
প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, 'প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালীকরণ ও তথ্যনির্ভর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে জাইকার সহায়তায় মিটার রিডিং অ্যাপ, ম্যানেজমেন্ট ড্যাশবোর্ড ও নন-রেভেনিউ ওয়াটার মনিটরিং টুল বাস্তবায়ন করছে। ফলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, অবৈধ পানি সরবরাহ বন্ধ এবং অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার কমানো সম্ভব হবে।'
