পানিতে পোকা, ভোগান্তিতে ঢাকার বাসিন্দারা, দায় নিতে নারাজ ওয়াসা

ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা এখন চরম পানি সংকটে ভুগছে—সরবরাহকৃত পানিতে পাওয়া যাচ্ছে পোকা আর কেঁচো। বারবার অভিযোগ করার পরও দায় অস্বীকার করে গেছে ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা)। ফলে হাজার হাজার মানুষ বাধ্য হচ্ছে ময়লা ও অনিরাপদ পানি ব্যবহারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, পানির এই সমস্যা শহরের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। তারা বলছেন, অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান জরুরি, এবং ওয়াসা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।
নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের বাসিন্দা আবুল হাসান তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, 'প্রথমে ভেবেছিলাম ময়লা, কিন্তু পরে দেখি পানিতে ছোট ছোট পোকা আর কেঁচো। এই পানি না খেতে পারি, না পারি রান্না করতে, না করতে পারি ঠিকমতো গোসল।'
তিনি আরও বলেন, 'সমস্যাটা দেখার পর বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছিলাম। উনি ট্যাংক পরিষ্কার করালেন, কিন্তু পোকা আসা বন্ধ হয়নি। ওয়াসাতেও অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।'
তবে ঢাকা ওয়াসার মেইনটেন্যান্স অপারেশন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সার্ভিসেস (এমওডিএস) জোন-৬-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইমরানুল ইসলাম এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমরা একাধিকবার অভিযোগ আসা এলাকাগুলোর পানির লাইন পরীক্ষা করেছি, কিন্তু ওয়াসার পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি পাইনি।'
তিনি আরও বলেন, 'সমস্যাটা বাড়ির ভেতরের ট্যাংক বা পাইপলাইনে থাকতে পারে। আমাদের পরিদর্শনে ওয়াসার পানিতে কোনো পোকা বা সমস্যা ধরা পড়েনি।'
কিন্তু একই ধরনের অভিযোগ করলেন কল্যাণপুরের রোড-১৩ এলাকার বাসিন্দা নঈমুর রহমান নাবিলও। তিনি বলেন, 'গত এক সপ্তাহ ধরে আমাদের পরিবারের সবাই চর্মরোগে ভুগছে। ওয়াসার পানি ভর্তি ছিল পোকায়। অসহ্য চুলকানি হতো। বাধ্য হয়ে বোতলের পানি কিনে খাচ্ছি। আমাদের পানির ট্যাংক পরিষ্কার করেও সমস্যার সমাধান হয়নি।'
নিউ ইস্কাটন ও কল্যাণপুরের বাইরে শ্যাওড়াপাড়া, মহাখালী, বাংলামোটর, তেজগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, মধুবাগ, খিলগাঁও, বনশ্রী, বাসাবোসহ আরও বহু এলাকা থেকে একই অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বনশ্রীর বাসিন্দা খান মোহাম্মদ মামুন বললেন, 'আমাদের আশপাশের প্রায় প্রতিটা বাসাতেই পানিতে ছোট ছোট কেঁচো পাওয়া গেছে। আমরা ওয়াসাকে অভিযোগ জানিয়েছি, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।'
খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া বাসিন্দা আবদুল আলিম ও মধুবাগের নজমুল তপনও একই অভিজ্ঞতার কথা বলেন। নাজমুল বলেন, 'গত ১০-১১ দিন ধরে আমাদের এলাকার, বিশেষ করে খেজুর গাছ গলির আশপাশের এলাকায় ওয়াসার পানিতে পোকা গিজগিজ করছে। ওয়াসার কর্মকর্তারা এসে সমস্যা দেখে গেছেন, কিন্তু পোকার সংখ্যা উল্টো বেড়েছে।'
মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। অবিলম্বে সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়ে স্থানীয়রা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, 'ওয়াসা যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আমাদের প্রতিবাদে নামতে হবে।'
ওয়াসার পদক্ষেপ
তবে ঢাকা ওয়াসা দায় নিচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসা এক বিজ্ঞপ্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করছে, গ্রাহকদের বাসাবাড়িতে ভূগর্ভস্থ ও ছাদে পানি সংরক্ষণের যে ট্যাংক আছে, সেখানেই সমস্যাটি হচ্ছে। এসব পরিষ্কার করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক গ্রাহক ওয়াসার কথামতো পানির ট্যাংক পরিষ্কার করেও কোনো ফল পায়নি।
ঢাকা ওয়াসার এমওডিএস জোন-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলমও জোর দিয়ে বলেন, ওয়াসার পাইপলাইনে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'আমরা অভিযোগ পেয়ে কল্যাণপুরের বাসাবাড়িগুলোতে গিয়েছি এবং অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের পাইপলাইনের পানি স্বচ্ছ এবং জীবাণুমুক্তই পেয়েছি। অধিকাংশ বাড়ির পানির ট্যাংকে পোকা জন্ম নিয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'লাইনের পানি প্রবহমান থাকে, তাই লাইনে এমন পোকা জন্ম নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে পাইপলাইনে কোথাও ফাটা কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে সমস্যা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আমরা আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষা করছি।'
ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) একেএম শহীদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'আমরা গত কয়েকদিনে পানির এ সমস্যা নিয়ে অন্তত ৪০টি অভিযোগ পেয়েছি এবং প্রতিটি জায়গায় আমাদের লোক পাঠিয়ে চেক করিয়েছি; কিন্তু আমাদের লাইনের পানিতে কোনো সমস্যা পাইনি।
'এছাড়া আমাদের ট্রিটেড (পরিশোধিত) পানিতে ক্লোরিন মিক্স করে পাঠানো হয়। ফলে এমন পোকা থাকলেও তা মারা যাওয়ার কথা।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোর পানি নিয়মিত টেস্ট করা হয়। কোথাও আমরা এই সমস্যা পাইনি। প্রতিদিন ঢাকায় বর্তমানে ২৮৫ থেকে ২৯০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছি—যার মাত্র কয়েকটি স্থানে অভিযোগ পাচ্ছি। এসবের অধিকাংশই বাড়িগুলোর ওয়াটার রিজার্ভারের সমস্যা।'
ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'এই সময়ে নদীর পানি দুর্গন্ধ ও পোকাযুক্ত বেশি থাকে। ফলে ট্রিটমেন্টে অতিরিক্ত কেমিক্যাল দিতে হয়। ফলে কোথাও সমস্যা হলে লাইনে দুর্গন্ধযুক্ত পানি যেতে পারে।
'এছাড়া ঢাকার অনেক জায়গায়ই ওয়াসার লাইনে লিকেজ রয়েছে, যেখানে এই সমস্যা ঘটতে পারে। তাছাড়া অবৈধ সংযোগের কারণেও পানির সমস্যা হতে পারে।'
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইনে পোকা পাওয়া মানেই লাইনের কোথাও ফাটল বা রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি আছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ লেনিন চৌধুরী বলেন, 'পানির পাইপে পোকা জন্মানোর অর্থ হচ্ছে বাইরের দূষণ পাইপের ভেতরে ঢুকে পড়ছে।'
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'পানিবাহিত রোগ নগরের প্রতিটি মানুষকে প্রভাবিত করে। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, নানা চর্ম রোগসহ নানা সমস্যায় ভুগতে হয় পানির সমস্যার কারণে। গত কয়েকদিনে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়ার রোগীও বেড়ে গেছে। তাই জোর করে হলেও ওয়াসার চলমান এই সমস্যার সমাধান করা জরুরি। মহামারি আকার ধারণ করার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'পানি উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিলে সুপেয় পানি সরবরাহের দায়িত্ব হচ্ছে ওয়াসার। কিন্তু বছরের পর বছর ওয়াসাকে দুর্নীতি এবং অনিয়মের আখড়ায় পরিণত করেছেন বিগত সময়ের যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা। তাই এখন উচিত ওয়াসার পূর্ণ সংস্কার করা। দরকার হলে সমস্ত বাজেট বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয় সরকারের হাতে দিতে হবে।'
চিকিৎসকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, পোকাযুক্ত পানি ব্যবহার করলে ত্বকে সংক্রমণ, পেটের অসুখসহ নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা পানি খেলে মারাত্মক ফল ফল হতে পারে।