২০ প্যানেল, ২০ পৃষ্ঠার ব্যালট, পূর্ণ প্যানেলে ছাত্রদলের জয়—যেমন ছিল ’৯০-এর ডাকসু নির্বাচন

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচন। একদিকে তৎকালীন সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা—এই দুই ধারার মেলবন্ধনেই নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ মিলিয়ে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ২০ পৃষ্ঠার ব্যালট পেপার আর প্রথমবারের মতো শিস কলম ব্যবহারের অভিজ্ঞতা—সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভূমিধস জয়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২০ প্যানেল, প্রার্থী ১,৫৩০ জন
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ২০টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৪৮৯ জন প্রার্থী। পাশাপাশি ১৪টি হল সংসদের ১৬৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আরও ১,০৪১ জন। আগের বছরের তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়—১৯৮৯ সালে যেখানে ছিল ১০টি প্যানেল, ১৯৯০ সালে তা দাঁড়ায় ২০টিতে। ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে সর্বাধিক ৩১ জন প্রার্থী লড়াইয়ে নামেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাও বেড়ে প্রায় ১০০ জনে দাঁড়ায়, যা আগের নির্বাচনের তুলনায় ছিল দ্বিগুণের বেশি।
২০ পৃষ্ঠার ব্যালট পেপার, শিস কলমের প্রথম ব্যবহার
১৯৯০ সালের নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে ডাকসুর জন্য ২০ পৃষ্ঠার ব্যালট পেপার ছাপাতে হয়েছিল। সংবাদ পত্রিকার ৬ জুনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের বাজেট ধরা হয়েছিল প্রায় ৪ লাখ টাকা। একই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো শিস কলম ব্যবহারের নিয়ম চালু হয়। এর আগে ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য কাঠ-পেন্সিল ব্যবহার করা হতো।
শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, ভোট দেন ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। পরদিন ৭ জুন দৈনিক সংবাদ-এর শিরোনাম ছিল— 'শান্তিপূর্ণভাবে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন'।
সে খবরে উল্লেখ করা হয়, মোট ২৮,৬৯০ জন ভোটারের মধ্যে ১৭,১৩৮ জন ভোট দেন। ফলে ভোট প্রদানের হার দাঁড়ায় ৬২.৫২ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'কড়া পুলিশি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বুধবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি হলে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হয় এবং বিরতিহীনভাবে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে। ভোট শেষ হলে সিলকরা বাক্সগুলো কড়া পুলিশি প্রহরায় কলা ভবনে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানেই গণনা শুরু হয়।'
দৈনিক ইনকিলাব ও ইত্তেফাকের ৭ জুনের প্রতিবেদনে একইভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
১৯৮৯ সালে ডাকসুর জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মুশতাক হোসেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৯০ সালে ৯ ছাত্র সংগঠনের প্যানেল থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নির্বাচনগুলো ছিল উৎসাহব্যঞ্জক ও অংশগ্রহণমূলক। গোটা ক্যাম্পাসে নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে পড়েছিল।"
যেমন ছিল প্যানেলগুলোর পোস্টারের ভাষা
নির্বাচনী পোস্টারে প্রতিটি প্যানেলে ছিল ভিন্নতা। প্যানেলগুলোর নির্বাচনী পোস্টারের ভাষার মধ্য দিয়ে তাদের অঙ্গীকার ও আহ্বান ফুটে উঠে সেসময়।
নির্বাচনের দিন ৬ জুন সংবাদ পত্রিকার শিরোনাম ছিল 'আজ ডাকসু নির্বাচন'। সেই খবরে প্যানেলগুলোর পোস্টারিং সম্পর্কে বলা হয়, ছাত্রলীগের (হা-অ) পোস্টারে আহ্বান জানানো হয়েছে—'স্বৈরাচার, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন।'
ছাত্রদলের পোস্টারে ছিল—'স্বৈরাচার ও সন্ত্রাস নির্মূল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার।'
ছাত্র ইউনিয়নের পোস্টারে লেখা ছিল—'অস্ত্র ও সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াও, বিপন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাও।'
৯ ছাত্র সংগঠনের পোস্টারে উল্লেখ ছিল— 'প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দালালদের উচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত সুস্থ ধারার ছাত্র আন্দোলনের আপোষহীন নেতৃত্ব।'
অন্যদিকে জাতীয় ছাত্রলীগের পোস্টারে ভোটারদের আহ্বান করা হয়েছিল— 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ফিরিয়ে আনুন।'
শুরুতে বিদ্রোহী প্যানেল, পরে ঐক্যবদ্ধ—ফলাফলে ভূমিধস জয় ছাত্রদলের
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে প্রথমদিকে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সমর্থিত ছিল আমান-খোকন পরিষদ। তবে ছাত্রদলের অপর অংশ থেকে শামসুজ্জামান দুদু ও আসাদুজ্জামান রিপন আলাদা করে ঘোষণা দেন দুদু-রিপন পরিষদ। পরবর্তীতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে দুদু ও রিপন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান, ফলে ছাত্রদল ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে।
ফলাফল আসে ছাত্রদলের ঐক্যবদ্ধ প্যানেলের পক্ষে ভূমিধস জয়ের মধ্য দিয়ে।
৮ জুন দৈনিক ইনকিলাব শিরোনাম করে— 'জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অভূতপূর্ব বিজয়।'
খবরে বলা হয়, ডাকসুর ভিপি, জিএস, এজিএসসহ কেন্দ্রীয় ২০টি পদের সবকটিতেই ছাত্রদলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ভিপি হন আমান উল্লাহ আমান, জিএস খায়রুল কবীর খোকন এবং এজিএস নাজিমউদ্দিন আলম। তারা প্রত্যেকেই প্রায় সাত হাজার ভোট পান, যা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বিগুণেরও বেশি।
হল সংসদেও একই চিত্র। ১৪টি হলের ১৬৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্রদল জয় পায় ১৩১টিতে, এর মধ্যে ৯টি হলে পূর্ণ প্যানেল।
ছাত্রলীগ দ্বিতীয় ও অন্যদের অবস্থা
ছাত্রলীগ দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে ২টি হলে পূর্ণ প্যানেলসহ ২৯টি পদে জয়ী হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ৭টি পদে, আর স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পান ১টি পদে। অন্যদিকে ৯ ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগ এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রার্থীরা কোনো পদে জয়ী হতে পারেনি।
৮ জুন দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল—'ছাত্রদলের বিপুল বিজয়'।
খবরে উল্লেখ করা হয়, ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে ছাত্রলীগ দ্বিতীয় এবং ৯ ছাত্র সংগঠন তৃতীয় অবস্থানে ছিল। ভিপি পদে ছাত্রলীগের শাহে আলম ৩,৬১৯ ভোট; জিএস পদে সৈয়দ কামরুল আহসান ৩,৪১৮ ভোট; ৯ সংগঠনের ভিপি প্রার্থী মুশতাক হোসেন ২,৬১২ ভোট ও জিএস প্রার্থী জহির উদ্দিন স্বপন ২,৭৫২ ভোট পান।
ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল পান ১,০৭১ ভোট এবং জিএস প্রার্থী নাসির উদদুজা পান ২,০৩০ ভোট। ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভিপি প্রার্থী আমিনুল ইসলাম পান ১,১৪৯ ভোট এবং জিএস প্রার্থী মুজিবুর রহমান পান ১,০৮৪ ভোট।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ৬টি প্যানেলের মধ্যে— বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (হা-অ) আলম-কামরুল পরিষদ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আমান-খোকন পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়নের বাবুল-নাসির পরিষদ, ৯ ছাত্র সংগঠনের মুশতাক-স্বপন পরিষদ, জাতীয় ছাত্রলীগের বুলবুল-কামাল পরিষদ এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের আমিন-মুজিব পরিষদ।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছিল '৯০ এর ডাকসু নির্বাচন
নব্বইয়ের ডাকসু নির্বাচন শুধু ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। বিশেষ করে, তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বেগবান করতে এ নির্বাচন বড় ভূমিকা রাখে।
ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "১৯৮৯ সালের ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক আচরণ এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরে এসেছিল। আমরা তখনই বলেছিলাম, যারা নির্বাচিত হবে তারা এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করবে।"
"'৮৯ সালের নির্বাচনে যে পারস্পরিক সম্মানের পরিবেশ গড়ে ওঠে, তার ধারাবাহিকতাতেই নব্বইয়ের ডাকসু নির্বাচন হয়। আর সেই নির্বাচনের পরই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন হয় এবং এরশাদের পতন ঘটে," যোগ করেন তিনি।
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হয়েছিলেন খায়রুল কবির খোকন, যিনি বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনই ছিল তখনকার ডাকসু নির্বাচনের মূল বিষয়। আমরা ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, নির্বাচিত হলে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাবো। ছাত্রসমাজ আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিল, আমরা নির্বাচিত হওয়ার পরই তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেই আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত বিজয় আসে।"