জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনে রদবদল শুরু

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ প্রশাসন গুছানোর কাজ শুরু করেছে সরকার। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)—এই চার পদে কোথায় কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
নির্বাচন উপলক্ষে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশের প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশের বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপি এবং কিছু ইউএনওকে নিয়ে অনলাইনে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি। বৈঠকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ক আলোচনা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে স্বরাষ্ট্র সচিব নির্বাচন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে নির্দেশ দেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বা একই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণাকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তাদের সমর্থকদের মারামারি বা সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এজন্য সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান ও পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম গতকাল সচিবালয়ে বৈঠক করেন।
জেলা পর্যায়ে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয় কীভাবে হবে, তা-ই ছিল আলোচনার মূল বিষয়। অনেক জেলায় এসপি পদে ডিসির চেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা রয়েছেন। এতে সমন্বয়ের অভাব বা মানসিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে ডিসি ও এসপিদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হবে। জানা গেছে, সিনিয়র এসপিদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন ডিসিরা।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে মোখলেস উর রহমান বলেন, "লটারির মাধ্যমে কখনো সিভিল সার্ভিসে পদায়ন হয়নি, এখনো হচ্ছে না, হবেও না। আমাদের ফিট লিস্ট আছে। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন ডিসি পদায়ন করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে ডিসি পদে যেসব যুগ্ম সচিব আছেন, তাদের তুলে আনা হবে। সেই জায়গায় বর্তমান ডিসিদের বদলি করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসন পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া মাঠে কাজ করতে পারে না। মাঠ প্রশাসন বলতে সিভিল ও পুলিশ—উভয়কেই বোঝায়।
বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন ২ সেপ্টেম্বর টিবিএসকে জানান, আগামী ৭ সেপ্টেম্বর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে জাতীয় নির্বাচনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হবে। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১২০ জন মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন ইউনিটে সব স্তরের পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচন উপলক্ষে পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ওসি নিয়োগ হবে লটারির মাধ্যমে। এসপিদের লটারি হবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এবং ওসিদের লটারি হবে বিভাগীয় পর্যায়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্র জানায়, এসপিদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনের আগে লটারি করে তাদের পদায়ন করা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সব জেলায় ডিসি ও সব উপজেলায় ইউএনও নিয়োগের পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। চাইলে সরকার যেকোনো সময় পরিবর্তন আনতে পারবে।
ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ডিসি নিয়োগের ফিট লিস্ট তৈরি করেছে। এতে বিসিএসের ২৮তম ব্যাচকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এরপরের দুই ব্যাচ থেকেও কয়েকজন রয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনী প্রশাসনের প্রস্তুতি আছে, তবে দ্রুত রদবদল হবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার আগে পরিবর্তন আনা হবে।
বর্তমানে ডিসি পদে দায়িত্বে আছেন ২৪তম, ২৫তম ও ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তারা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২৫তম বিসিএসের কর্মকর্তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আর ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারা যোগ দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। আরও কয়েক জেলায়ও পরিবর্তন হতে পারে।
ডিসি, ইউএনও, এসপি ও ওসি—এই চার পদ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডিসিরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রার্থিতা যাচাই, প্রতীক বরাদ্দসহ পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনা করেন। ইউএনওরা থাকেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা। তবে আগামী নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকবেন কি না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপ দিয়েছে।
কমিশন জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের প্রথমভাগে তফসিল ঘোষণা করা হবে। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসন কমিশনের অধীনে চলে যায় এবং বদলি-পদায়নের ক্ষমতা কমিশনের হাতে থাকে। এজন্য তফসিল ঘোষণার আগে মাঠ প্রশাসন গুছিয়ে নিচ্ছে সরকার।
গত আগস্টে আট জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে পাঁচ জেলায় নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তিন জেলায় বদলি করা হয়েছে।
একইভাবে সাত জেলায় নতুন এসপি নিয়োগ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিভাগীয় কমিশনারের অফিসের মাধ্যমে ইউএনও ও এসি ল্যান্ডসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হচ্ছে।
৪ হাজার এএসআই নিয়োগ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৪ হাজার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
বুধবার জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান আইজিপি বাহারুল আলম।
তিনি জানান, এএসআই নিয়োগের অর্ধেক সরাসরি এবং বাকি অর্ধেক পদোন্নতির মাধ্যমে হবে।
"এ বিষয়ে বিধিতে কিছু সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তা করছে। এতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে এই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এবং প্রধান উপদেষ্টা নীতিগতভাবে এতে সম্মতি দিয়েছেন," যোগ করেন তিনি।