মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার চালানে পাথর, কোনোটির ওজন ৩০ কেজি পর্যন্ত: তদন্তে উন্মোচন

গত মার্চে ১,২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লার একটি চালানে ছিল পাথর— প্রায় ১৫০টি, যারমধ্যে কিছু ছিল ৩০ কেজি পর্যন্ত ওজনের। বিদ্যুৎ বিভাগের তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
১১তম চালানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কয়লা খালাস করার পর এই পাথরগুলো ধরা পড়ে। এমভি ওরিয়েন্ট অর্কিড নামের জাহাজে করে ৬৩ হাজার ৩০০ টন কয়লা ১৭ মার্চ মাতারবাড়ি জেটিতে ভেড়ে।
পাথর ছাড়াও কয়লার চালানটি ছিল পানিতে ভেজা এবং মাটি ও লালচে বর্ণের অনাহুত উপাদান মেশানো, যা এর ওজন বাড়িয়ে দেয়।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
গত বুধবার (২৭ আগস্ট) তিনি টিবিএসকে বলেন, "হ্যাঁ, আমি বিষয়টি জানি। সরবরাহকারী মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পাথর মেশানো কয়লা এনেছে, যার মধ্যে কিছু পাথরের ওজন ছিল ৩০ কেজি পর্যন্ত।"
এই মিশ্রণ বা দুষণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে শুরুতে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ পুরো চালানই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল। তবে পরে শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল— কয়লা থেকে পাথর ও অন্যান্য অনাহুত পদার্থ সরবরাহকারীর খরচে আলাদা করা, অতিরিক্ত পানির ওজন মেপে কয়লার প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং বন্দরে জাহাজ আটকে থাকার ফি প্রদান।
'ভারী বৃষ্টিপাত দায়ী'
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড আনুষ্ঠানিকভাবে সরবরাহকারীকে চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি জানিয়েছে। এই সরবরাহকারী হচ্ছে— বাংলাদেশের মেঘনা গ্রুপ এবং ভারতের আদিত্য বিরলা গ্রুপের পূর্ণ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান- আদিত্য বিরলা গ্লোবাল ট্রেডিং (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেডের যৌথ কনসোর্টিয়াম।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কনসোর্টিয়ামের একটি দল কয়লা ইয়ার্ড পরিদর্শন করে স্বীকার করেছে যে, চালানে অতিরিক্ত বড় আকারের পাথর, কাদা, লালচে পদার্থ এবং ব্যাপক পরিমাণে পানিভেজা কয়লা ছিল।
তদন্ত কমিটি অতিরিক্ত পানির কারণ জানতে চাইলে সরবরাহকারী দাবি করে, ইন্দোনেশিয়ার খনি থেকে লোডিং বন্দরে পরিবহনের সময় "ভারী বৃষ্টি"র কারণে এমন হয়েছে।
কিন্তু অতিরিক্ত বড় পাথর ও অন্যান্য অনাহুত পদার্থের স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। শুধু জানিয়েছে, 'ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবে'।
প্রত্যাখ্যাত কয়লা গ্রহণে মেঘনা গ্রুপের চাপ
মেঘনা গ্রুপ ও তাদের অংশীদার প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিকে অনুরোধ জানায়, যাতে দূষিত কয়লার চালানটি গ্রহণ করা হয়। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, ম্যানুয়ালি কয়লা থেকে পাথর, কাদা এবং লালচে পদার্থ আলাদা করে দেওয়া হবে।
কিন্তু পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জানায়, মোট ৬৩ হাজার ৩০০ টন কয়লার মধ্যে ২২ হাজার ৭৭৪ টন আনলোড করা হয়েছে, এবং এর মধ্যেই প্রায় ১৫০টি অতিরিক্ত বড় পাথর পাওয়া গেছে। বাকি কয়লাতেও আরও এমন পাথর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
কোম্পানি সতর্ক করে দিয়ে জানায়, এ ধরনের অনাহুত উপাদানে দূষিত কয়লা ব্যবহার করলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ
তদন্ত কমিটি ভবিষ্যতের চালানে এ ধরনের দূষণমুক্ত কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে।
আগামীতে এমন দূষিত কয়লার চালান ঠেকাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেটিতে কয়লা আসার পর সরবরাহকারীর উপস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহ করে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। এতে আরও সুপারিশ করা হয় যে, আনলোডের আগে একটি জরিপ কমিটি পরীক্ষা করে দেখবে কয়লায় অতিরিক্ত পানি বা অনাহুত পদার্থ আছে কি-না।
তদন্ত কমিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অপারেটরকে সরবরাহ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছে।
১১তম চালান খালাসের সময় কয়লা থেকে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা, পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি কোম্পানিকে তাও খতিয়ে দেখে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলেছে কমিটি।
তদন্তে এমন চিত্র উঠে আসার পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে জ্বালানি উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান টিবিএস-কে বলেন, "আমরা সরবরাহকারীকে কয়লা থেকে পাথর ও অন্যান্য ফরেন মেটার আলাদা করার নির্দেশ দিয়েছি। জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে ছিল এবং সরবরাহকারীকে ওভারস্টে ফি দিতে হয়েছে। এটা ছিল একটা টাফ পানিশমেন্ট।"
তিনি আরও জানান, ব্যবহারযোগ্য ও ব্যবহার অনুপযুক্ত কয়লা আলাদা করতে একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই অনিয়মের ঘটনায় কোনো আর্থিক জরিমানা দেওয়া হবে কি-না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, "তদন্ত প্রতিবেদন এখনও আমার ডেস্কে আসেনি। একবার পেলেই বিষয়টি আমি দেখব।"
এক বছরের চুক্তির আওতায় মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩৫ লাখ টন কয়লা সরবরাহের চুক্তি পেয়েছে মেঘনা গ্রুপ ও আদিত্য বিরলা গ্রুপ। যার আওতায় এই চালান নিয়ে আসা হয়।
দূষিত কয়লার চালান তদন্তের জন্য গত ২৪ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগ যুগ্মসচিব মোহাম্মদ সানাউল হক (উন্নয়ন-১) এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।
টিবিএস কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির একটি ফাঁস হওয়া আনুষ্ঠানিক চিঠির ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাথর ও অনাহুত উপাদান মিশ্রিত কয়লার বিষয়টি সামনে আসে।
কয়লা গ্রহণকারী কমিটি তখন বাধ্য হয়ে চালানের আনলোডিং বন্ধ করে দেয়। কারণ কয়লার অতিরিক্ত আঠালোভাবের কারণে কনভেয়ার বেল্ট ও জেটির স্থায়ী স্ক্রিন বারবার জট বাঁধছিল এবং অচল হয়ে পড়ছিল।