চাকসু নির্বাচন: ‘মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ বিষয়ক পদ সংযোজনের দাবি শিক্ষার্থীদের

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন আগামী ১২ অক্টোবর। ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে চাকসু নির্বাচনের তফসিলও। তবে, নতুন পরিমার্জিত চাকসুর গঠনতন্ত্রে নেই 'মুক্তযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন' বিষয়ক কোনো পদই।
নানা সময়ে গঠনতন্ত্র সংস্কার প্রস্তাবনায় বিভিন্ন সংগঠন এ পদ রাখার দাবি জানিয়ে আসলেও বিষয়টি আমলে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষার্থী ও সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ ৩৫ বছর পরে আয়োজিত হতে যাচ্ছে চাকসু নির্বাচন। নির্বাচন উপলক্ষে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ক্রিয়াশীল সংগঠনের দাবির প্রেপরিক্ষিতে পূর্বের গঠনতন্ত্রে আনা হয়েছে বেশ কিছু সংশোধনীও। তবে 'মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন' বিষয়ক পদের দাবি উঠলেও সংযোজিত হয়নি এ পদটি।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল চবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, ''মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে। 'মুক্তিযুদ্ধ' বিষয়ক পদ রাখা দরকার। তবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক পদ এটা একটি ভিন্ন বিষয়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক অবশ্যই রাখা দরকারভ এটা আমরা আমাদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে রেখে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি।''
গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক পদ রাখা উচিত কি না এ প্রশ্নের জবাবে ছাত্রদলের এই নেতা বলেন, ''মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন একসঙ্গে যায় না। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দুইটা আলাদা বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব।''
তবে গঠনতন্ত্রে 'মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন' বিষয়ক পদ না রাখার বিষয়ে নোমান বলেন, ''এ বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রশাসন আমাদের আশ্বাস দিয়েছে যে এ বিষয়ে তারা কথা বলবেন।''
মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতি করার কথা জানিয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির চবি শাখার সাহিত্য সম্পাদক সাঈদ বিন হাবিব।
তিনি বলেন, ''মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এর পরবর্তী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেমন ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোন, চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের বিরাট অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন একে অপরের পরিপূরক। এ বিষয়ে পদ রাখার জন্য আমরা ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে দাবি জানিয়েছি। তবে প্রশাসন এখনো আমাদের এ দাবির বিষয়ে কিছু জানায়নি।''
তিনি বলেন, ''আমরা বিশ্বাস করতে চাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের এ যৌক্তিক দাবি নিয়ে পুনরায় ভাববেন এবং 'মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন' বিষয়ক পদ রাখার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিবেন।''
গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল চবি শাখার সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, ''বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এসকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষোভ প্রতিফলিত হয়েছে। এরই বহিঃপ্রকাশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীন সার্বভৌমত্বের মানদণ্ড ৷''
তিনি বলেন, ''পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ এর শিক্ষা আন্দোলন, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ২০০৬ সালে ফুলবাড়িয়ার আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন এবং সবশেষ ২০২৪ এর ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থান। এসব আন্দোলন করেছি মুক্তিযুদ্ধকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন একই বিষয়।''
তিনি আরও বলেন, ''এসব ইতিহাস বলার জন্য এবং রক্ষার জন্য আমাদের একজন প্রতিনিধি দরকার। এছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদটি রাখা হয়েছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এই পদটি রাখার জন্য প্রস্তাব করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানাই।''
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদাউস রিতা বলেন, ''চাকসুতে 'মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক' পদটি থাকা অত্যন্ত জরুরি। কেননা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান— প্রতিটি আন্দোলনই আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে।''
তিনি বলেন, ''এই ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক চর্চার মূল কেন্দ্র সবসময়ই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এই ইতিহাসের চর্চা ও চেতনা বহন করা প্রয়োজন। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত গঠনতন্ত্রে এই সম্পাদকীয় পদটি অন্তর্ভুক্ত করা।''
শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের শিক্ষার্থী তাহসিনা রহমান বলেন, ''চাকসুর গঠনতন্ত্রে অবশ্যই দপ্তর সম্পাদকের পদ সবার জন্য উন্মুক্ত করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক পদ যুক্ত করতে হবে। কেননা মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শেকড়ের বিষয়। সাতচল্লিশ-বায়ান্ন-উনসত্তরের একটা সমাধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। নিজেদের বাংলাদেশি পরিচয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ সংযুক্ত সেক্ষেত্রে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে আনা বা সেটাকে সংরক্ষণের কাজ করা জরুরি।''
তিনি বলেন, ''চব্বিশের গণমানুষের অভ্যুত্থান নিয়ে কাজ করার সুযোগ ও এই সম্পাদকের থাকবে। আবার বাংলার ইতিহাস বলে আমরা বিপ্লবী। কাজেই ক্যাম্পাসে পরবর্তী সময়ে যত ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে সেটা নিয়েও কাজ করার সু্যোগ আছে। একজন ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-চব্বিশ সহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে কাজ করার সুযোগ প্রয়োজন।''
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, "অনেকগুলো দাবি এসেছে। 'মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন' বিষয়ক পদ রাখার জন্য দাবি এসেছে, আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসব। এসব বিষয়ে আলোচনা করে যদি মনে হয় আরেকটি পদ বাড়ানো দরকার, সে বিষয়ে আমরা ভেবে দেখব।''
চাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ অনুযায়ী, খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে আগামী ১ সেপ্টেম্বর। ১৪ সেপ্টেম্বর শুরু হবে মনোনয়নপত্র বিতরণ এবং পরেরদিন থেকেই চলবে মনোনয়নপত্র জমাদান। মনোনয়নপত্র বিতরণের শেষ হবে ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত।
মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টার। ১৮ সেপ্টেম্বর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ হবে ২১ সেপ্টেম্বর। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৩ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টা।
প্রার্থীদের বিষয়ে আপত্তি গ্রহণ ও নিষ্পত্তির শেষ সময় ২৪ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হবে প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা। সবশেষ ভোটগ্রহণ হবে ১২ অক্টোবর (রবিবার) সকাল ৯টা থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত। একইদিনে প্রকাশিত হবে ফলাফল।