সাদাপাথর লুট: দুদক প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ৫৩; প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র থেকে পাথর লুটের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে এই নজিরবিহীন লুটপাটের সঙ্গে ব্যবসায়ী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এক বিরল আঁতাতের চিত্র উঠে এসেছে।
দুদক সদরদপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদনে ৫৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রকাশ হওয়ামাত্রই সিলেটে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অভিযুক্ত বিএনপি, জামায়াত ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন।
গত ১৩ আগস্ট দুদকের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাতের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন করে। ধারাবাহিক অনুসন্ধানের পর ১৬ আগস্ট প্রাথমিক প্রতিবেদনটি ঢাকায় পাঠানো হয়।
দুদকের তদন্তে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে স্থানীয় প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় এই রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট শুরু হয় এবং গত তিন মাসে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। সংরক্ষিত পর্যটন এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এখান থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর লুট করা হয়েছে।
দুদকের উপ-পরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাত বলেন, 'প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য উপাত্ত পেয়েছি সেগুলো প্রতিবেদন আকারে পাঠানো হয়েছে। আরও তদন্ত চলছে।'
অভিযুক্তদের তালিকায় যারা
দুদকের প্রতিবেদনে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর দায়িত্বে অবহেলার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, খনি ও খনিজসম্পদ বিধিমালা ২০১২ এর বিধি ৯১ ও ৯৩ অনুযায়ী খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ এলাকায় অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা ও অবৈধভাবে সম্পদ উত্তোলন করা যাবে না। কেউ করলে ব্যুরো তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সাদাপাথরে ধারাবাহিকভাবে লুটপাট চললেও ব্যুরো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এছাড়াও অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী, সদ্য ওএসডি হওয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ এবং কোম্পানীগঞ্জের সাবেক ও বর্তমান চারজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) - আবিদা সুলতানা, ঊর্মি রায়, মোহাম্মদ আবুল হাছনাত ও আজিজুন্নাহার।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনানের বিরুদ্ধেও লুটপাটে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ৪২ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীসহ ২০ জন বিএনপি নেতা, মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফখরুল ইসলাম ও জেলা সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন, জেলা এনসিপি-র প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরী এবং সাতজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। এছাড়াও ভোলাগঞ্জের আরও ১১ জন ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ অস্বীকার ও প্রতিক্রিয়া
প্রতিবেদন প্রকাশের পর বুধবার ও বৃহস্পতিবার পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মহানগর বিএনপি সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী অভিযোগটিকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে বলেন, 'আমি বৈধভাবে পাথর তোলার পক্ষে বললেও লুটের পক্ষে নই।' এছাড়া, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য দুদককে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।
সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফখরুল ইসলাম দাবি করেছেন, দুদকের প্রতিবেদনে তাদের কোনো নেতাকর্মীর নাম নেই এবং সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খবর প্রকাশ করছে। এনসিপি নেতারাও এই প্রতিবেদনকে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন।
এদিকে, অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপনে থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রশাসনের ভূমিকা ও রদবদল
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার পাথর ব্যবসায়ীদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন। জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের পাথর লুটপাট ঠেকাতে সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ সুপার ও কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসির বিরুদ্ধে পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে লুটপাটে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পাথর বোঝাই প্রতি ট্রাক থেকে পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য দশ হাজার টাকা এবং প্রতিটি বারকি নৌকা থেকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হতো।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই সিলেটের জেলা প্রশাসককে ওএসডি এবং কোম্পানীগঞ্জের ইউএনওকে বদলি করা হয়। তবে অভিযুক্ত বাকি কর্মকর্তারা এখনো স্বপদে বহাল আছেন।
এ বিষয়ে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেন, 'পাথর লুটে প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও সম্প্রতি পাথর লুটে স্থানীয় প্রশাসনের দায় থাকার কথা উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন সিলেটের রাজনীতি ও প্রশাসনে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।