রেকর্ড উৎপাদনের পরেও কেন বাড়ছে পেঁয়াজের দাম?

চলতি বছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে দামও ছিল ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে। তবে আগস্টের শুরু থেকে বাড়তে শুরু করে পেঁয়াজের দাম; দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে বেড়ে যায় প্রায় ৩০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, টানা বৃষ্টি ও তাপমাত্রার কারণে বাতাসে আর্দ্রতা (হিউমিডিটি) বেড়ে যাওয়ায় সংরক্ষিত পেঁয়াজ দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে, দীর্ঘদিন ধরে আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমে বাজারে দাম বেড়ে গেছে।
বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮৫ টাকায়। কিছু জায়গায় ৯০ টাকাও বিক্রি হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৬০-৬৫ টাকা এবং তার আগে দীর্ঘদিন ৫৫-৬০ টাকার মধ্যে ছিল।
যদিও গত মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে আমদানির অনুমতির খবরে বুধবার থেকে পাইকারি পর্যায়ে কেজিতে অন্তত ১০-১৫ টাকা দাম কমেছে।
রেকর্ড উৎপাদন, তবু নষ্টের হার বেশি
সর্বশেষ মৌসুমে দেশে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ লাখ ২৪ হাজার টন বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ৪২ লাখ ৪৫ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ লাখ ২১ হাজার টন।
এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৯ লাখ ১১ হাজার টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৬ লাখ ৪০ হাজার টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল।
তবে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ২০-২৫ শতাংশই উৎপাদন, সংগ্রহ, বাজারজাত ও সংরক্ষণ পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। সংরক্ষণ অবকাঠামোর দুর্বলতার কারণে চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন করেও এর সুফল ভোক্তা ও কৃষক পান না।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়নের বাঐটোলা গ্রামের কৃষক রহমান প্রামাণিক বলেন, "এবার কৃষকদের মধ্যে অনেকের অর্ধেকের বেশি পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি প্রায় ৫০০ টনের মতো পেঁয়াজ রেখেছিলাম, এর মধ্যে ১০০-১৫০ টন পচে গেছে। আগে কখনো এমনটা হয়নি।"
নওগাঁর মান্দা উপজেলার সতিহাটের বড় পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মোতাহার হোসেন বলেন, "দেশীয় বাজারে সংরক্ষিত পেঁয়াজ শেষের দিকে, ফলে সরবরাহ কমেছে এবং দাম বেড়েছে। তবে এখন দাম কমা শুরু হয়েছে। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত থাকলে বাজার দ্রুত স্বাভাবিক হবে।"
নওগাঁ সদর উপজেলার ভীমপুর গ্রামের পেঁয়াজ চাষী গোলাম মোস্তফা বলেন, "এবার পেঁয়াজ চাষ করে লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছিল। তাই মৌসুমের শুরুতেই সব পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। চাষীদের কাছে এখন আর পেঁয়াজ নেই, হয়তো ব্যবসায়ীদের কাছে আছে। তারা চাইলে সিন্ডিকেট করতে পারবে। তবে পেঁয়াজ উৎপাদনের সরকারি তথ্য আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। এই কারণেই প্রতি বছর দেশে ঘাটতি দেখা দেয়।"
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নূর আলম চৌধুরী বলেন, "এবার দেশে ৩৬ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে, যেখানে দেশের চাহিদা অন্তত ৪০ লাখ টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের অন্তত ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের সময় নষ্ট হয়, বাকিটাই আমাদের কাজে লাগে। এই হিসাব বলছে দেশে ঘাটতি রয়েছে। এখন বাজারে সরবরাহ কমায় দাম বাড়ছে, যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ।"
পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য ও সংরক্ষণ নিয়ে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদেরও
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, "টানা বৃষ্টিপাতের কারণে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে গিয়ে পেঁয়াজে পচন ধরছে। এবার বৃষ্টি বেশি হওয়ায় কৃষকের পেঁয়াজ পচে যাওয়ার এটিও একটি কারণ হতে পারে।"
"সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন, কিন্তু এবার বৃষ্টির কারণে অনেকের চারা নষ্ট হয়ে গেছে। যারা পলিশেডে চাষ করছেন, তারা কিছুটা সফল হয়েছেন," যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক আবু নোমান আরও বলেন, "সঠিক উৎপাদন পরিসংখ্যান এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাজার ঠিক রাখতে হলে উৎপাদনের সঠিক তথ্য থাকা জরুরি।"
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা নূর আলমও জানান, ভালো সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকলে রেকর্ড উৎপাদন হলেও চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। নষ্টের হার কমানো না গেলে উৎপাদনের সুফল ভোক্তা ও কৃষক কেউই পাবে না।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরে পৌঁছেছে ১০০ টন ভারতীয় পেঁয়াজ
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির মধ্যে দীর্ঘ ৮ মাস পর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। গতকাল (১৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় ভারতের ১০০ টন পেঁয়াজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরে পৌঁছায়।
পানামা সোনামসজিদ পোর্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মাইনুল ইসলাম জানান, চারটি ট্রাকে করে এসব পেঁয়াজ এসেছে। তিনি বলেন, "এই চালান পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির স্থবিরতা কাটল।"
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আশা প্রকাশ করেছেন, প্রতিবেশী দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরুর ফলে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং দাম স্থিতিশীল হবে।