মার্কিন শুল্ক শঙ্কায় জুলাইয়ে কার্গো পরিবহন বৃদ্ধি, যানজটে অচলাবস্থায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

চলতি জুলাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আমদানি-রপ্তানির চাপ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) সঙ্গে পণ্য পরিবহন বাড়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা।
রপ্তানিযোগ্য পণ্য বোঝাই কাভার্ড ভ্যানের দীর্ঘ সারির কারণে বন্দরমুখী লেন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে সীতাকুণ্ডের কুমিরা থেকে চট্টগ্রাম শহরের এ কে খান গেট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথ, স্বাভাবিক সময়ে ২০ মিনিটে পার হওয়া গেলেও, এখন তা পার হতে সময় লাগছে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা।
এতে শুধু সময়ই নয়, এই যানজট জীবননাশের কারণও হয়ে উঠেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, জুলাই মাসে মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
রপ্তানি পণ্যের চাপ বেড়েছে
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে চট্টগ্রামের ১৯টি আইসিডিতে রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ গড়ে ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। তবে সীতাকুণ্ডের পাঁচটি আইসিডিতে এই বৃদ্ধির হার আরও বেশি—১২৭ শতাংশ থেকে ২৬৩ শতাংশ পর্যন্ত। একই সময়ে আমদানিকার্যও জুনের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এই অতিরিক্ত চাপের মূল কারণ ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়া। এর আগে যতো দ্রুত সম্ভব পণ্য পাঠিয়ে দিতে চেয়েছেন রপ্তানিকারকরা। তৈরি পোশাকের (আরএমজি) সিজন (মৌসুমি চাপ) চলতে থাকায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চাপ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড
বিকডার তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে চট্টগ্রামের আইসিডিগুলো মোট ৮৫,০০০ টিইইউ (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভালেন্ট ইউনিট) পণ্য হ্যান্ডল করেছে—যা জুনের ৩২,০০০ টিইইউ থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। একই সময়ে আমদানিকৃত কার্গোর পরিমাণ ১৩,০০০ টিইইউ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫,০০০ টিইইউতে। রপ্তানি ও আমদানি—উভয় ক্ষেত্রেই জুলাইয়ের পরিমাণ গত সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতিমাসেই রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ আমদানির তুলনায় বেশি ছিল। জানুয়ারিতে রপ্তানি ছিল ৭০,৩৩৮ টিইইউ—যা ২১,০৩৯ টিইইউ আমদানির তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি হয় ৬১,৬৭২ টিইইউ, আর আমদানি ২১,৮৪৭ টিইইউ। মার্চে রপ্তানি হয় ৬৩,৬৯২ টিইইউ—যেখানে আমদানি ছিল ২১,২৬৪ টিইইউ।
তবে এপ্রিলে রপ্তানি ও আমদানির ব্যবধান কিছুটা কমে আসে। ওই মাসে রপ্তানি হয় ৪৯,৩৪৫ টিইইউ এবং আমদানি ২২,৪৭৬ টিইইউ। যদিও মে মাসে রপ্তানি আবারও বেড়ে দাঁড়ায় ৭২,৫১৬ টিইইউতে—যা আমদানি (২৬,৫৪৫ টিইইউ) থেকে প্রায় তিনগুণ বেশি। জুন মাসে এ সময়কার মধ্যে আমদানি-রপ্তানিতে সবচেয়ে কম রেকর্ড হয়—রপ্তানি ৩২,৩৫৫ টিইইউ এবং আমদানি ১২,৯৬০ টিইইউ।
জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে কুমিরার কেডিএস লজিস্টিকস, সোনাইছড়ির বিএম ডিপো, ভাটিয়ারির পোর্ট লিংক এবং এ কে খান গেটসংলগ্ন সামিট-ইস্পাহানির ওপর। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার ও শিপিং লাইনগুলো প্রতিদিন যেখানে সর্বোচ্চ ৪০০ ট্রাক গ্রহণে সক্ষম, সেখানে ৭০০ পর্যন্ত ট্রাক পাঠানো হচ্ছে—ফলে অতিরিক্ত যানবাহন দিনভর মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকছে, যা যানজট আরও তীব্র করে তুলছে।
সীতাকুণ্ডে মহাসড়কের পাশে ছয়টি আইসিডি
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে ৩০ কিলোমিটার জুড়ে ছয়টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) রয়েছে—কুমিরায় নেমসান ও কেডিএস লজিস্টিকস, সোনাইছড়িতে বিএম ডিপো, ভাটিয়ারিতে পোর্ট লিংক এবং কর্টলিতে গোল্ডেন ও আইএসএটিএল। এছাড়া বসবারিয়ায় একটি নতুন আইসিডি বে লিংকের নির্মাণকাজ চলছে।
এই সব ডিপো মহাসড়কের একেবারে পাশে হওয়ায় ট্রাকের প্রবেশ ও প্রস্থান নিয়মিতভাবে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। কার্গোর চাপ বেড়ে গেলে সিরিয়াল পেতে মহাসড়ক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
ডিপোভিত্তিক রপ্তানি কার্গোর বৃদ্ধি
সবচেয়ে বড় আইসিডি কেডিএস লজিস্টিকস জুন মাসে ৪,৬৪১ টিইইউ রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডল করলেও জুলাইয়ে তা ১৬৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১২,২৩০ টিইইউতে। পোর্ট লিংকে ২২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে জুনের ২,৮১৮ টিইইউ থেকে জুলাইয়ে হয়েছে ৯,১৯৯ টিইইউ। বিএম ডিপোতে হ্যান্ডলিং বেড়েছে ১২৭ শতাংশ—২,৪২২ থেকে বেড়ে ৫,৫০৩ টিইইউ হয়েছে। নেমসান ডিপোতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে—২৬৩ শতাংশ; জুনের ৭৭২ টিইইউ থেকে জুলাইয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ২,৮০৭ টিইইউ।
এই প্রবাহের কারণে অনেক কাভার্ড ভ্যানকে ডিপোতে প্রবেশের জন্য তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ফলে মহাসড়কে চলাচলের জায়গা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
পার্কিং সংকট ও সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা
ট্রাকচালকদের অভিযোগ, আইসিডিগুলোতে পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা নেই। তবে ডিপো পরিচালনাকারীরা বলছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তারা ২০০ থেকে ৫০০ ট্রাক হ্যান্ডল করতে সক্ষম। তাদের দাবি, চলমান বিশৃঙ্খলার মূল কারণ সমন্বয়ের অভাব।
তারা জানান, অনেক রপ্তানিকারক ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের নির্দিষ্ট সময়সূচি ছাড়া আগেভাগেই পণ্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন, ফলে ট্রাকগুলো ডিপোর বাইরে দিনের পর দিন আটকে থাকছে।
কেডিএস লজিস্টিকসের নির্বাহী পরিচালক আহসানুল কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শিপিং লাইনগুলোর জন্য ডিপোগুলোতে নির্দিষ্ট শেড বরাদ্দ থাকে। রপ্তানিকারকরা ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের জন্য বুকিং দেন। এরপর শিপিং কোম্পানিগুলো স্লট বরাদ্দ দিলে সেই অনুযায়ী পণ্য ডিপোতে পাঠানো হয়। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের দেওয়া শিডিউল অনুযায়ী কন্টেইনারে স্টাফিং করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য বন্দরে পাঠানো হয়।"
তিনি আরও বলেন, "রপ্তানিকারকরা যখন ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের কাছ থেকে শিডিউল না নিয়ে আগেভাগে পণ্য পাঠিয়ে দেন, তখনই সমস্যা দেখা দেয়। শিডিউল না থাকলে ডিপোতে পণ্য গ্রহণ করা যায় না। ফলে ট্রাকগুলোকে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।"
অভিজ্ঞ এই ডিপো অপারেটরের মতে, রপ্তানিকারকরা যদি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার ও শিপিং কোম্পানির সঙ্গে সমন্বয় করে পণ্য পাঠান, তাহলে এই সমস্যার সহজেই সমাধান সম্ভব।
তবে পণ্য পরিবহন কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক ও প্রাইম মুভার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহম্মদ দাবি করেছেন, কেডিএস, বিএম, পোর্ট লিংক ও সামিট-ইস্পাহানি পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা দিতে না পারায় সীতাকুণ্ড এলাকায় যানজট চরমে উঠেছে।
তিনি বলেন, "আইসিডি নীতিমালা অনুযায়ী ডিপোগুলো পার্কিং চার্জ নিতে পারে না। তারপরও আমরা ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত চার্জ দেই। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির পিক সিজনে যদি যথেষ্ট পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে ডিপোর সামনে এভাবে যানজট লাগত না।"
সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা যে কয়টি সমস্য চিহ্নিত করেছি, তার মধ্যে এটি হলো পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেসের অভাব। অন্যটি সমন্বয়ের অভাব। ডিপোগুলোকে আমরা কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করছি, কিছুদিনের মধ্যে যানজট সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া যাবে।"
ডিপোর সংখ্যা ও সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ
গত কয়েক বছর ধরে দেশের আমদানি ও রপ্তানি—উভয়ই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। প্রতি বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই চার মাস রপ্তানি শিপমেন্টের পিক সিজন হিসেবে ধরা হয়। এই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
তবে এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলোর (আইসিডি) সক্ষমতা তেমন বাড়েনি। সরকার প্রতিদিনের পার্কিং চার্জ মাত্র ৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়ায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ফেরতের নিশ্চয়তা নেই—এই আশঙ্কায় ডিপোগুলো চড়া দামে জমি কিনে অতিরিক্ত পার্কিং স্পেস তৈরি করতেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতে দেশের আইসিডির সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার।
তিনি বলেন, "বন্দরের নিজস্ব সরকারি জায়গায় ২০০ টাকা পার্কিং চার্জ নেওয়া হয়। অথচ ডিপোগুলো নিজেদের কেনা বা ভাড়া করা জায়গায় মাত্র ৫০ টাকা পার্কিং চার্জ নিতে পারে। এত কম টাকায় ডিপোগুলো কীভাবে অতিরিক্ত পার্কিং স্পেস দেবে?"
যানজটের কারণে সীতাকুণ্ডে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা
দীর্ঘসময় যানজটে আটকে থেকে বিরক্ত ও অস্থির হয়ে ওঠেন চালকরা। একবার যানজট কাটলেই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া থেকে অনেকেই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। কেউ কেউ উল্টো পথে চলাচলও শুরু করেন। এতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ছে।
হাইওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সীতাকুণ্ড এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ১১ জন। এপ্রিলে ৬ জন, মে মাসে ৮ জন এবং জুনে ৬ জনের মৃত্যু হয়। তবে শুধু জুলাই মাসেই ৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৩ জন—যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
বারোআউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল মোমেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জুলাই মাসজুড়ে এবং আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিদিনই ডিপোগুলোর আশপাশে যানজট লেগে আছে। অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে চালক ও সহকারীরা হাইওয়ে পুলিশকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও কোনো কার্যকর সমাধান হচ্ছে না।"